
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শনিবার (৩ মে) অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশ থেকে নতুন দুটি রাজনৈতিক কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। নারীর ন্যায্য অধিকার ও চার দফা দাবির প্রেক্ষিতে সংগঠনটি আগামী তিন মাসের মধ্যে দেশের প্রতিটি বিভাগে সম্মেলন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি আগামী ২৩ মে, শুক্রবার বাদ জুমা দেশব্যাপী চার দফা দাবির পক্ষে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে বলেও জানানো হয়েছে।
হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান মহাসমাবেশে এ ঘোষণা দেন। সকাল ৯টা থেকে শুরু হওয়া এই মহাসমাবেশে সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী ঢাকায় এসে জড়ো হন। দিনভর স্লোগান, ধর্মীয় ভাষণ ও দাবিনামা পাঠের মাধ্যমে জমে ওঠা সমাবেশ শেষ হয় হেফাজতের আমির শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবু নগরীর মোনাজাতের মাধ্যমে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছাড়াও আশপাশের রাস্তায় ছিল উপচে পড়া ভিড়; শাহবাগ, বাংলা মোটর, টিএসসি এলাকা ও নীলক্ষেত পর্যন্ত যান চলাচল ব্যাহত হয়।
চার দফা প্রধান দাবি
হেফাজতের মহাসমাবেশ মূলত চার দফা দাবিকে সামনে রেখেই আয়োজন করা হয়। এ দাবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—হেফাজত নেতাদের নামে থাকা প্রায় ৩০০টি মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার। হেফাজতের দাবি অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনায়, ২০২১ সালের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় এসব মামলা করা হয়। এছাড়া:
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল,
সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনর্বহাল,
ফিলিস্তিন ও ভারতে মুসলমানদের গণহত্যা ও নিপীড়ন বন্ধের আন্তর্জাতিক দাবি—এই তিনটি দাবিও তুলে ধরা হয়।
সমাবেশে অংশ নিয়ে ইসলামি চিন্তাবিদ ও ভারতীয় ধর্মীয় নেতা সাইয়্যেদ এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী বলেন, “অসংখ্য নিরপরাধ আলেম-ওলামাকে জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করে কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছে। যদি লুৎফুজ্জামান বাবর জামিন পান, তবে আলেমদের মুক্তির দাবিও ন্যায়সংগত।” তিনি আরও বলেন, “এ দেশে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন করে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসে আঘাত হানা হয়েছে। সংস্কারের আগে বন্দি আলেমদের মুক্তি দিতে হবে। না হলে কোনো নির্বাচনই হতে দেওয়া হবে না।”
এনায়েতুল্লাহ সরকারের প্রতি ইঙ্গিত করে আরও বলেন, “মানবিক করিডরের নামে বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত সংঘাতে জড়ানো হলে এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। সরকার যেন যুদ্ধের আগুনে দেশকে ঠেলে না দেয়।”
হেফাজতের কেন্দ্রীয় সদস্য মাহমুদ বিন হোসাইন বলেন, “এই সমাবেশ প্রমাণ করে যে হেফাজতের কর্মীরা কুরআনবিরোধী যেকোনো কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত।” তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, “সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। অন্যথায় হেফাজতের কর্মসূচি আরও তীব্র হবে।”
এর আগে সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হেফাজত নেতাকর্মীরা গাড়ি, ট্রাক ও বাসযোগে ঢাকায় এসে জড়ো হন। তাদের বহনকারী যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা যায় গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী এলাকায়। মূল সমাবেশস্থলে ঠাঁই না পেয়ে অনেকেই শাহবাগ, দোয়েল চত্বর ও টিএসসি মোড়ে অবস্থান নেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি থাকলেও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের সঙ্গে দীর্ঘদিন পরোক্ষ বিরোধে থাকা হেফাজত এ সমাবেশের মধ্য দিয়ে আবারও সক্রিয় রাজপথে ফিরে এসেছে। বিশেষ করে নারী কমিশন ও সংবিধান সংশোধনের মতো ধর্মীয় ইস্যুতে তারা সাধারণ মুসলমানদের মাঝে সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করছে।
আগামী ২৩ মে’র বিক্ষোভ কর্মসূচির পর হেফাজতের পরবর্তী বিভাগীয় সম্মেলনগুলোতে রাজনৈতিক ভাষ্য আরও কঠোর হবে বলে ধারণা করছেন পর্যবেক্ষকরা। অনেকেই বলছেন, সামনের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর সক্রিয়তা নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি করতে পারে।
এই মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে হেফাজত ইসলাম আবারও তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে যে, তারা শুধু একটি ধর্মীয় সংগঠন নয়, বরং একটি প্রভাবশালী সামাজিক শক্তি—যারা ইসলাম, মুসলমান ও আলেমদের স্বার্থে দেশের যেকোনো জায়গায় ‘মাঠে নামার’ জন্য প্রস্তুত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ