
ছবি: সংগৃহীত
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল, শাপলা চত্বরের গণহত্যার বিচার ও রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শনিবার (৩ মে) এক মহাসমাবেশ করেছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। এই মহাসমাবেশ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে গণ্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সরাসরি সতর্ক করে হেফাজতের শীর্ষ নেতারা বলেন, "শেখ হাসিনার মতো ভুল করবেন না। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে কুরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো নীতিকে কখনোই স্থান দেওয়া যাবে না।"
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ্ মুহিব্বুল্লাহ্ বাবুনগরী। ভোর থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জমায়েত হতে শুরু করেন। সকাল ৯টার মধ্যে হেফাজতের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্ট উলামায়ে কেরাম সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন। পরে শুরু হয় বক্তব্য পর্ব, যেখানে একে একে বিভিন্ন নেতা তাদের অবস্থান তুলে ধরেন।
সমাবেশের মূল দাবি ছিল চারটি:
১. নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ও তার প্রস্তাব বাতিল,
২. শাপলা চত্বরে সংঘটিত 'গণহত্যার' বিচার নিশ্চিত করা,
৩. হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার,
৪. মুসলিম বিশ্বে বিশেষত ফিলিস্তিন ও ভারতে মুসলমানদের ওপর চলমান নিপীড়নের বিরুদ্ধে সরকারের কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করা।
হেফাজতের নেতারা ড. ইউনূসকে ইঙ্গিত করে বলেন, "আপনি পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার করেছেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছেন, কিন্তু ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগ করে যেসব ধর্মপ্রাণ মুসলমান শহীদ হয়েছেন, সেই ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। এ বিষয়ে আজও কোনো তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়নি। এটা কি বৈষম্য নয়?"
সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মুফতি ফখরুল ইসলাম বলেন, "আমরা নির্যাতিত হয়েছি, জেল খেটেছি, কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা আজও চলমান। অথচ অন্য রাজনৈতিক দলের মামলাগুলো অনেক আগেই প্রত্যাহার হয়েছে। এই ন্যায়হীনতা বন্ধ করতে হবে।"
সমাবেশে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করা হয় নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ও তার প্রতিবেদন নিয়ে। হেফাজতের নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ওই কমিশনের সদস্যদের পরিচয় স্পষ্ট নয়, অথচ তাদের প্রস্তাবনা সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহবিরোধী। বক্তারা বলেন, “সংস্কার কমিশনের এমন প্রস্তাব ১৮ কোটি মুসলমানের ঈমান-আকীদার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। এটি বাস্তবায়িত হলে জীবন দিয়ে হলেও আমরা তা প্রতিরোধ করব। যদি এই প্রস্তাব প্রত্যাহার না করা হয়, তবে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা অভিমুখে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাধ্য হবে।”
এছাড়া ফিলিস্তিন ও ভারতের মুসলমানদের প্রতি সংহতি জানিয়ে বক্তারা বলেন, “আজ বিশ্ব মুসলিম নিপীড়িত, আর বাংলাদেশ সরকার নীরব। ফিলিস্তিনে গাজায় রক্তপাত চলছে, ভারতে মুসলমানদের ওপর চলছে সংগঠিত নিপীড়ন—এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারকে আন্তর্জাতিক ফোরামে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।”
সমাবেশে বক্তারা আরও বলেন, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ইসলাম রক্ষার প্রশ্নে কোনো আপস করে না এবং ভবিষ্যতেও করবে না। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন যেকোনো উদ্যোগ প্রতিহত করা হবে—এ হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেন তারা।
বক্তব্যে অনেকে ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের ঘটনাকে “গণহত্যা” আখ্যা দিয়ে বলেন, “যেভাবে নিরস্ত্র, শান্তিপূর্ণ মুসল্লিদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাতের আঁধারে হামলা চালিয়েছিল, তা ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। অথচ সেই ঘটনার আজও বিচার হয়নি। এটি রাষ্ট্রের দোষ নয় কি?”
সমাবেশ শেষে হেফাজতের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে বলা হয়, যদি নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল না করা হয় এবং শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডের বিচার না হয়, তাহলে ধর্মপ্রাণ জনতার দাবির মুখে হেফাজতে ইসলাম আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবে। তারা সরকারকে সাবধান করে বলেন, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা যদি রাষ্ট্রীয় মদদে কাজ করতে থাকে, তাহলে পরিস্থিতির দায় সরকারকে নিতে হবে।
মহাসমাবেশে উত্থাপিত দাবিগুলো সরকারের নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে, বিশেষ করে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন একটি সম্ভাব্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রেক্ষাপটে। হেফাজতের এই বক্তব্য দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক উত্তেজনার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ