
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশ এক বছরের ব্যবধানে এক লাফে ১৬ ধাপ উন্নতি করেছে—এই সাফল্যের কারণ হিসেবে সরকারি হস্তক্ষেপের অনুপস্থিতিকে চিহ্নিত করেছেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম।
২০২৫ সালের ৩ মে, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস্’ (RSF) প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স অনুযায়ী, ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৪৯তম, যেখানে গত বছর বাংলাদেশ ছিল ১৬৫তম অবস্থানে। এ অবস্থানগত অগ্রগতি দেশে গণমাধ্যম স্বাধীনতার সূচকে এক যুগে বিরল উন্নয়নের দিকনির্দেশনা দিচ্ছে বলে মনে করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্টরা।
শুক্রবার (২ মে) এ সূচক প্রকাশের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, “বর্তমান সরকার গণমাধ্যমের ওপর কোনো হস্তক্ষেপ করছে না। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ সব গণমাধ্যম এখন সরকারের প্রভাবমুক্তভাবে পরিচালিত হচ্ছে। কোনো প্রতিষ্ঠানকে ফোন করে সংবাদ প্রচারে প্রভাবিত করা হয় না।”
তিনি আরও বলেন, “আন্তর্জাতিক সংগঠন RSF-এর সূচকে বাংলাদেশের ১৬ ধাপ উন্নতি প্রমাণ করে যে, এই সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং পেশাদার সাংবাদিকতার বিকাশে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেশের গণতন্ত্র ও তথ্য অধিকার রক্ষায় গণমাধ্যম একটি শক্তিশালী স্তম্ভ, এবং সরকার সেই স্তম্ভকে সংহত করতে চায়।”
তথ্য উপদেষ্টা আরও জানান, দেশের গণমাধ্যম খাতে সংস্কার ও বিকাশের জন্য ‘গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন’ গঠন করা হয়েছে, এবং এই কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে অচিরেই কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, “পরবর্তী বছরে বাংলাদেশ আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে এবং সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা আরও সুসংহত হবে।”
২০২৫ সালের প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে বাংলাদেশ পেয়েছে ৩৩.৭১ স্কোর, যেখানে গত বছর ২০২৪ সালে স্কোর ছিল ২৭.৬৪। স্কোরের দিক দিয়ে এটি একটি উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন, যদিও ১০০ নম্বরের এই সূচকে বাংলাদেশ এখনও তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে।
RSF-এর মূল্যায়নে গণমাধ্যম স্বাধীনতা পরিমাপ করা হয় পাঁচটি সূচকে—রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থনৈতিক চাপ, আইনগত প্রতিবন্ধকতা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক চাপ এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি। এসব বিবেচনায়ই বাংলাদেশের অবস্থান নির্ধারণ করা হয়।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের এই অগ্রগতি স্পষ্ট হলেও, এটি এখনো মধ্যম বা শক্তিশালী গণমাধ্যমের গড় মানে পৌঁছায়নি। তবে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে উত্তম। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের অবস্থান এই বছর ১৫১তম, যা বাংলাদেশের দুই ধাপ পেছনে।
তবে RSF-এর অতীত প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২১তম, কিন্তু পরবর্তী ১৫ বছরে তা একসময় নেমে এসেছিল ১৬৫তম স্থানে। এই সময়কালে দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, সংবাদপত্র বন্ধ ও সাংবাদিক গ্রেফতারের মতো ইস্যুগুলো নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমবারের মতো বিশ্ব গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে—এমনটি দাবি করে উপদেষ্টা বলেন, “বর্তমান সরকার একটি অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারসম্মত শাসন নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর অংশ হিসেবেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হচ্ছে।”
অন্যদিকে, দেশে পেশাদার সাংবাদিকরা বলছেন, সত্যিকারের গণমাধ্যম স্বাধীনতা মানে কেবল হস্তক্ষেপ না থাকা নয়, বরং সাংবাদিকদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ, তথ্য প্রাপ্তির স্বাধীনতা, মানহানির মামলার ভয় না থাকা এবং স্বাধীনভাবে তদন্তমূলক রিপোর্ট প্রকাশের নিশ্চয়তা থাকা জরুরি।
তারা আশা করছেন, সরকারের এই সদিচ্ছা শুধু আন্তর্জাতিক সূচক উন্নয়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং মাঠপর্যায়ে বাস্তব পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশের গণমাধ্যম খাত আরও গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও পেশাদার হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম খাত একসময় চাপে ও নিয়ন্ত্রণে থেকেও এখন ধীরে ধীরে আরও উন্মুক্ত পরিবেশে প্রবেশ করছে, এমন ইঙ্গিত দিচ্ছে নতুন সূচক। তবে এই উন্নয়ন ধরে রাখার জন্য কেবল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নয়, বাস্তবিক নীতিমালা ও আইনি কাঠামোতে গণমাধ্যমবান্ধব সংস্কার এখন সময়ের দাবি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ