
ছবি: সংগৃহীত
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘২২৬ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়েছি’ মন্তব্যসহ একটি অডিও ক্লিপের ফরেনসিক বিশ্লেষণে সেটির সত্যতা নিশ্চিত করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। ৩০ এপ্রিল বুধবার সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে সংস্থাটি জানায়, অডিওটির ফরেনসিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে—বক্তব্যটি শেখ হাসিনার কণ্ঠেই রেকর্ড করা হয়েছে এবং এতে তিনি বলেছেন, “২২৬টি মামলা হয়েছে, মানে ২২৬ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়েছি।”
এই মন্তব্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত এবং বিচারক, তদন্ত কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের হুমকি দেওয়ার উপাদান রয়েছে বলে মত দিয়েছে প্রসিকিউশন। এর ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে রুল জারি করেছে। রুলে প্রশ্ন রাখা হয়েছে, কেন তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। এ বিষয়ে শিগগিরই আনুষ্ঠানিক শুনানি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, জুলাই-আগস্ট মাসে সারাদেশে সংগঠিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, গণহত্যা এবং নিরীহ নাগরিকদের বিরুদ্ধে দমনপীড়নের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট ১৪৫ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তদন্ত চলছে। এসব অপরাধকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে তদন্ত সংস্থা। এখন পর্যন্ত এসব অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ২৩টি ‘মিস কেস’ (Miscellaneous Cases) দায়ের করা হয়েছে।
তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়, শুধুমাত্র রাজধানীর চাঁনখারপুল এলাকায় ছয়জন নিরীহ বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করার ঘটনায় আটজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে সেই তদন্ত প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর দপ্তরে দাখিল করা হয়েছে এবং তা চিফ প্রসিকিউটরের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এই মামলায় এখন আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র (Formal Charge) দাখিল এবং অভিযোগ গঠন সংক্রান্ত শুনানি নিয়ে আলোচনার প্রক্রিয়া চলছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন (ICT Act) অনুসারে, কোনো মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে দাখিল হওয়ার পর সেটি যাচাই-বাছাই করে রাষ্ট্রপক্ষ আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দাখিল করে। এরপর ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন করবে কি না তা নির্ধারণ করতে রাষ্ট্রপক্ষ এবং আসামিপক্ষের মধ্যে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আদালত অভিযোগ গঠনের আদেশ দিলে শুরু হয় মূল বিচারিক প্রক্রিয়া এবং সাক্ষ্যগ্রহণ, যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত রায় ঘোষণা করে। রায়ের এক মাসের মধ্যে আসামিপক্ষ চাইলেই আপিল বিভাগের কাছে আবেদন করতে পারে।
প্রসঙ্গত, কয়েক মাস আগে প্রসিকিউশন পক্ষ প্রথমবারের মতো ট্রাইব্যুনালে আদালতের কার্যক্রমকে হুমকিস্বরূপ একটি অডিও ক্লিপ জমা দেয়, যেখানে শেখ হাসিনার কথিত বক্তব্যে তিনি নিজের সরকারের সময়ে দায়ের হওয়া ২২৬টি মামলাকে ‘হত্যার লাইসেন্স’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তখনই আদালত এই ক্লিপটির ফরেনসিক পরীক্ষার নির্দেশ দেয়। পরীক্ষার ফলাফলে বক্তব্যের সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার পর এটি মামলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
আদালত অবমাননার মামলায় বিচারকাজে হস্তক্ষেপ এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি ভয়ভীতির পরিবেশ তৈরি করাকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের রুল জারির ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এই অভিযোগে এখন আনুষ্ঠানিকভাবে আইনের মুখোমুখি হতে হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, ফরেনসিক প্রমাণসহ একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আদালত অবমাননার রুল জারি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। এর মাধ্যমে আদালত একটি বার্তা দিতে চেয়েছে যে, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
এদিকে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কাজ, প্রসিকিউশন এবং তদন্ত সংস্থা সব পক্ষই আগের চেয়ে অধিক সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের পর যেভাবে পুরনো অভিযোগগুলো পুনরুজ্জীবিত হয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে—বাংলাদেশের মানবতাবিরোধী অপরাধবিষয়ক বিচার ব্যবস্থায় নতুন করে গতি এসেছে।