
ছবি: সংগৃহীত
দুই পাশে দিগন্তজোড়া সবুজ ধানের খেত, সামনেই বিস্তৃত এক অপূর্ব পাহাড়ি প্রেক্ষাপট। এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্যপটে দাঁড়িয়ে যে কেউ ভুলে যেতে পারেন নিজের অবস্থান। দূরের দেশের মতো অপরূপ এই ল্যান্ডস্কেপ বাস্তবে দেখা যায় খাগড়াছড়ি শহর থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরের একটি এলাকাতেই। স্থানটির নামই ‘নিউজিল্যান্ড’। নামটি এখন আর শুধু কৌতূহলের খোরাক নয়, বরং এটি ধীরে ধীরে খাগড়াছড়ির একটি আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্যে রূপ নিচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় সরকার ও খাগড়াছড়ি পৌরসভার উদ্যোগে প্রায় এক দশক পর এই এলাকায় নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে একটি সড়ক, যা পানখাইয়াপাড়া ও আপা পেরাছড়াকে যুক্ত করেছে। এটি শুধু দুটি এলাকার যোগাযোগ সুবিধা বাড়ায়নি, বরং পুরো এলাকার পর্যটন সম্ভাবনাকেও নতুন মাত্রা দিয়েছে।
নতুন এই সড়কের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬শ মিটার। খাগড়াছড়ি পৌরসভার অধীনে নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নির্মিত এই সড়কে ব্যয় হয়েছে ৮ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহিরুল ইসলাম জানান, সড়কটির কাজ সম্পূর্ণ হওয়ায় এখন এর পাশ ঘেঁষে ফুটপাত নির্মাণ এবং স্ট্রিট লাইট বসানোর কাজও চলমান। পাশাপাশি, সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে ধারে ধারে ফুলের গাছ লাগানোর পরিকল্পনাও রয়েছে।
সড়কটি চালু হওয়ার পর থেকেই এখানে বেড়েছে দর্শনার্থীর সংখ্যা। প্রতিদিন বিকালে, বিশেষ করে ছুটির দিনে স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে বাইরের পর্যটকরা ছুটে আসছেন এই এলাকায়। কেউ আসছেন ছবির জন্য, কেউ শরীরচর্চা করতে, আবার কেউ শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য অবগাহনের জন্য।
স্থানীয় বাসিন্দা কবিতা চাকমা বলেন, “সড়কটি আগে ব্যবহারের অনুপযোগী ছিল, তাই কেউ আসতেন না। এখন পুরো এলাকার চেহারাই বদলে গেছে। সড়কের পাশে দাঁড়ালে যে পাহাড় দেখা যায়, তা মন ছুঁয়ে যায়। যানবাহনের চাপও কম, ফলে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হতে কোনো সমস্যা হয় না। তবে ফুলের গাছ লাগানো হলে এটি আরও মোহনীয় হয়ে উঠবে।”
নিউজিল্যান্ড এলাকায় প্রায় নিয়মিত বেড়াতে আসেন আরেক বাসিন্দা চেলছি ত্রিপুরা। তিনি জানান, “শহরের মধ্যে সময় কাটানোর তেমন ভালো জায়গা নেই। কিন্তু নতুন সড়কটি চালু হওয়ার পর থেকে এখানেই সময় কাটাই। অনেকে ভোরে প্রাতঃভ্রমণেও আসেন। বর্ষায় মেঘ দেখা যায় এখান থেকে। একটি সড়ক কীভাবে পুরো এলাকার পরিবেশ পাল্টে দিতে পারে, তা এখানেই বোঝা যায়।”
এই জায়গার নাম ‘নিউজিল্যান্ড’ কেন—তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য না থাকলেও স্থানীয়দের মতে, আলুটিলা পাহাড় থেকে দেখলে এই অঞ্চল অনেকটা নিউজিল্যান্ডের মতন মনে হয়। সেই থেকে লোকমুখে জায়গাটির নাম হয়ে গেছে ‘নিউজিল্যান্ড’।
এখন শুধু স্থানীয়রা নন, পর্যটকদের মধ্যেও এই জায়গা নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি আর ভিডিও দেখে অনেকে আগ্রহ নিয়ে ছুটে আসছেন এখানে।
বেসরকারি ভ্রমণ সংস্থা ‘ঝটিকা সফর’-এর প্রতিষ্ঠাতা জান্নাতুল ফেরদৌসি মানু সম্প্রতি নিজে গিয়ে এলাকা ঘুরে দেখেছেন। তিনি বলেন, “নিউজিল্যান্ড নামে জায়গাটি শুনে আগ্রহ জন্মেছিল। এসে দেখি, বাস্তবেও এটি ছবির মতোই সুন্দর। আজ একটু বৃষ্টির পর চারপাশ আরও সবুজ হয়ে উঠেছে। প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক অসাধারণ গন্তব্য হতে পারে এটি। খাগড়াছড়িতে বেড়াতে এলে যে কেউ যেন অন্তত একবার এখানে না এসে থাকতে না পারেন।”
খাগড়াছড়ি শহরকে পর্যটনবান্ধব নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে দীর্ঘদিন ধরে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে ‘নিউজিল্যান্ড’ এলাকাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হতে চলেছে। এলাকাটি যেমন স্থানীয়দের জন্য নির্মল বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টি করছে, তেমনি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত পর্যটকদের জন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা দিচ্ছে।
ভবিষ্যতে পরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে নিউজিল্যান্ড হয়ে উঠতে পারে খাগড়াছড়ির অন্যতম দর্শনীয় স্থান—যেখানে প্রকৃতি ও আধুনিক নাগরিক সুবিধার অপূর্ব সংমিশ্রণ থাকবে। যত্ন করে গড়ে তুললে, এই ‘নিউজিল্যান্ড’ হতে পারে বাংলাদেশের পর্যটন মানচিত্রে নতুন এক উজ্জ্বল ঠিকানা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ