
ছবি: সংগৃহীত
আজকের বৈশ্বিক বাস্তবতায় যুদ্ধের হুমকি আর অনিশ্চয়তা যেন প্রতিনিয়ত আমাদের ঘিরে রাখছে। আর এ ধরনের উত্তাল পরিস্থিতিতে কোনো দেশের সামরিক প্রস্তুতি না থাকাকে 'আত্মঘাতী' বলে আখ্যায়িত করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বুধবার (৩০ এপ্রিল) রাজধানীর কাছে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ঘাঁটি ‘বীর উত্তম এ কে খন্দকার’-এ আয়োজিত বার্ষিক সামরিক মহড়া ‘আকাশ বিজয় ২০২৫’-এর সমাপনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে তিনি এই মন্তব্য করেন।
মহড়ার সমাপ্তি পর্বে প্রধান উপদেষ্টা নিজে বিভিন্ন সামরিক অনুশীলন ও কারিগরি প্রদর্শনী প্রত্যক্ষ করেন এবং বাংলাদেশের বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হন।
অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধবিরোধী। আমরা চাই না পৃথিবীতে আর কোনো যুদ্ধ হোক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা এমন এক বিশ্বে বাস করছি, যেখানে প্রতিনিয়ত যুদ্ধের হুমকি আমাদের চারপাশে বিরাজমান। এই প্রেক্ষাপটে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি না রাখা আমাদের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে।”
তিনি বলেন, “যুদ্ধপ্রস্তুতি অনেক সময় যুদ্ধকে উসকে দেয়, এ নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে যে অনিশ্চয়তা চলছে, তাতে একটি দেশ হিসেবে আমাদের পুরোপুরি অপ্রস্তুত থাকা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আধা-আধি প্রস্তুতির কোনো জায়গা নেই।”
প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে আরও বলেন, “শুধু সামরিক বাহিনীর মধ্যে নয়, এই প্রস্তুতি জাতীয়ভাবে আত্মবিশ্বাস তৈরি করে। দেশের নাগরিকরাও সাহস পায়, যখন তারা দেখে তাদের বাহিনী প্রস্তুত, দক্ষ ও আধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত।”
ড. ইউনূস দেশের বর্তমান আর্থিক অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, “আমাদের অর্থনীতি এখন দুর্বল। দীর্ঘদিনের শাসনব্যবস্থায় দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং পরিকল্পনার অভাবে রাষ্ট্রের সম্পদ লুটপাট হয়েছে। এসব কারণে আমরা এখন যে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে আছি, তা সহজে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।”
তিনি যোগ করেন, “এই দুর্বল অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের সার্বিক প্রস্তুতির প্রয়োজন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। কারণ দুর্বল রাষ্ট্র নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়ে। তাই অর্থনৈতিক সংকটের মাঝেও আমাদের বাহিনীগুলোর উন্নয়ন ও প্রস্তুতিতে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে।”
প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সাম্প্রতিক অগ্রগতির প্রশংসা করে বলেন, “বিমানবাহিনী শুধু প্রযুক্তিনির্ভরতায় নয়, আত্মনির্ভরতায়ও সফলতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা কৌশলগত সক্ষমতা অর্জন করেছে, যা অত্যন্ত গর্বের বিষয়।”
তিনি বলেন, “পেশাগত দক্ষতা এবং কারিগরি প্রস্তুতি বজায় রাখাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে, সেই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদেরও আধুনিকায়িত করতে হবে। সরকার এই কাজে বিমানবাহিনীকে সব ধরনের সহযোগিতা করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।”
এ সময় প্রধান উপদেষ্টা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “আমরা এমন একটি উন্নত ও শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়তে চাই, যার প্রতিটি বাহিনী যুগোপযোগী, দক্ষ এবং আত্মবিশ্বাসে পূর্ণ থাকবে।”
জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকারের অবস্থান সুদৃঢ় বলেই জানান ড. ইউনূস। তিনি বলেন, “বিমানবাহিনী বিশ্বের আধুনিক মানদণ্ডে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সার্বভৌমত্ব রক্ষার এই চ্যালেঞ্জে তাদের সক্রিয় ভূমিকা প্রশংসনীয়। সরকার চায় একটি যুগোপযোগী, আধুনিক ও কার্যকর বিমানবাহিনী গড়ে তুলতে। এ লক্ষ্যে বাজেট, প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে পূর্ণ সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।”
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, “শুধু বাহিনী নয়, পুরো জাতিকে প্রস্তুত থাকতে হবে। স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। আত্মরক্ষা এবং প্রতিরোধের সক্ষমতা না থাকলে আমাদের সার্বভৌমত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। তাই একে কেবল সামরিক বিষয় বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না, এটা জাতীয় অস্তিত্বের প্রশ্ন।”
বিমানবাহিনীর বার্ষিক মহড়া ‘আকাশ বিজয় ২০২৫’ একটি ব্যাপক কৌশলগত মহড়া, যেখানে আধুনিক যুদ্ধ বিমানের মোতায়েন, রাডার পরিচালনা, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যুদ্ধকালীন উদ্ধার ও লজিস্টিক সাপোর্টের অনুশীলনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড প্রদর্শিত হয়।
এই মহড়ায় বাংলাদেশের নিজস্ব তৈরি কিছু প্রযুক্তির সফল প্রয়োগও দেখা গেছে, যা দেশের প্রতিরক্ষা খাতে আত্মনির্ভরতার দিকে অগ্রগতির বার্তা দেয়।
আজকের বিশ্বে যেখানে ভূরাজনীতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে, সেখানে কৌশলগত প্রস্তুতির বিকল্প নেই—এমন বার্তাই দিতে চাইলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। যুদ্ধ না চাইলেও যুদ্ধের হুমকিকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না, সেই বাস্তবতাকে সামনে রেখে সরকার একটি আত্মবিশ্বাসী, প্রস্তুত এবং প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ