
ছবি: সংগৃহীত
সরকারি স্বাস্থ্য খাতে কর্মরত প্রায় সাড়ে ৭ হাজার চিকিৎসকের বহুপ্রতীক্ষিত পদোন্নতি প্রক্রিয়া উচ্চ আদালতের একটি স্থগিতাদেশের কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে গেছে। তবে এ সংকটের জন্য এডহক থেকে ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকদের নয়, বরং নিয়মিত স্বাস্থ্য ক্যাডারের কয়েকজন চিকিৎসকের বিরূপ ভূমিকাকে দায়ী করছে বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকদের অ্যাসোসিয়েশন।
মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিস্তারিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত অ্যাসোসিয়েশন দাবি করেছে, পদোন্নতির এই জটিলতা মূলত সৃষ্ট হয়েছে স্বাস্থ্য ক্যাডারের অভ্যন্তরীণ কিছু পক্ষের একচেটিয়া দাবি ও আইনি অপব্যাখ্যার কারণে। সংস্থাটি বলছে, ১৪ জানুয়ারি স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, স্বাস্থ্য ক্যাডারে কর্মরত সকল ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসক, প্রকল্পে কর্মরত চিকিৎসক এবং এডহক থেকে ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকদের সমানভাবে পদোন্নতির আওতায় আনা হবে। এ লক্ষ্যে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার সুপারনিউমেরারি পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতির পথ সুগম করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
তবে এই পদোন্নতির উদ্যোগের বিরুদ্ধে কিছু স্বাস্থ্য ক্যাডারের চিকিৎসক উচ্চ আদালতে যান এবং আদালতে দাবি করেন, ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকরা কোনোভাবেই পদোন্নতির যোগ্য নন। তারা একধরনের অপপ্রচারও চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে, যেখানে বলা হচ্ছে যে, বিসিএস (স্বাস্থ্য) নন-ক্যাডার চিকিৎসকরা রীট মামলার মাধ্যমে সব পক্ষের পদোন্নতির ওপর স্থগিতাদেশ চেয়েছেন। তবে অ্যাসোসিয়েশন বলছে, বাস্তবে এই রীট দায়ের করেছেন স্বাস্থ্য ক্যাডারের কিছু চিকিৎসকই এবং তারাই পদোন্নতির অগ্রযাত্রায় বাধা সৃষ্টি করছেন।
বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক ডা. মো. জাকির হুসেইন বলেন, “আমরা আইনের আশ্রয় নিয়ে আবেদন করেছি যাতে আদালত নির্দেশ দেন, আমাদের বাদ দিয়ে যেন কোনো পক্ষকে পদোন্নতি দেওয়া না হয়। কারণ একটি পক্ষের দায়ে অন্য পক্ষের অধিকার খর্ব হতে পারে না।” তিনি আরও জানান, ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে স্থগিতাদেশের ব্যাখ্যা দিয়ে অনুলিপি প্রেরণ করা হয়েছে।
সংগঠনের সদস্য সচিব ডা. মো. জাহীদ ইকবাল জানান, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংকটে নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের মধ্যে প্রায় ৪ হাজার ১৩৩ জনকে ২০১০-১১ সালে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে এডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ২০১৫ সালে তাদের চাকরি নিয়মিত করা হয় এবং ২০১৭ সালে এই চিকিৎসকদের ক্যাডারভুক্ত করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রক্রিয়া শুরু হয়। অবশেষে ২০২২ সালে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সুপারিশক্রমে ২ হাজার ১ জন চিকিৎসককে বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
তবে এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যেও পদোন্নতির জন্য উপযুক্ত বহু চিকিৎসক বছরের পর বছর অপেক্ষায় থেকেছেন। অনেক চিকিৎসক স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী হলেও ডিপিসিতে জায়গা পাননি। এসব চিকিৎসক দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন সংগঠনের নেতারা।
অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ২০২২ সালে স্বাস্থ্য ক্যাডারের কিছু চিকিৎসক এই ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে হীন উদ্দেশ্যে রীট দায়ের করেন। যদিও হাইকোর্ট সেই রীটের ওপর সম্পূরক আবেদন খারিজ করে দেয় এবং বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনকে সুপারিশ প্রদানে কোনো বাধা না রাখে। এরই ধারাবাহিকতায় পিএসসি ২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ক্যাডার পদে চাকরি স্থায়ীকরণের সুপারিশ করে। কিন্তু প্রজ্ঞাপন প্রকাশের আগমুহূর্তে স্বাস্থ্য ক্যাডারের কিছু চিকিৎসক ফের আপিল বিভাগে গিয়ে স্থগিতাদেশ নেন এবং এই মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পদোন্নতি প্রক্রিয়া বন্ধ থাকে।
এ অবস্থায় অ্যাসোসিয়েশন মনে করছে, উচ্চ আদালতের দেওয়া স্থগিতাদেশ শুধুমাত্র ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকদের পদোন্নতিকে নয়, বরং পুরো পদোন্নতি প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তারা আদালতের প্রতি সম্মান রেখেই বলছেন, এই স্থগিতাদেশের ফলে দেশের চিকিৎসা সেবার কাঠামো ও মান আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে। যেসব চিকিৎসক দীর্ঘদিন ধরে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের ন্যায্য অধিকার হরণ করা হচ্ছে।
নেতারা মনে করেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং কিছু গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে চিকিৎসকদের পদোন্নতি বারবার থেমে যাচ্ছে। এই সমস্যা অবসানে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানায় অ্যাসোসিয়েশন।
তারা স্পষ্ট করে বলেন, আইন মেনে, ন্যায্যতার ভিত্তিতে এবং সব পক্ষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে পদোন্নতির কাজ শেষ করতে হবে। অন্যথায় চিকিৎসক সমাজের মধ্যে হতাশা আরও ঘনীভূত হবে এবং এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ