
ছবি: সংগৃহীত
রাখাইনে মানবিক করিডোর দেওয়ার বিষয়ে সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে তীব্র উদ্বেগ ও ক্ষোভ জানিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দলটি মনে করে, এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র অনৈতিক নয়, বরং দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের ওপর একটি গুরুতর হুমকি তৈরি করতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের এমন একতরফা পদক্ষেপ গ্রহণে জনগণের কোনো ম্যান্ডেট নেই বলেও মন্তব্য করেছে দলটি।
সোমবার রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির নিয়মিত বৈঠকে এসব মন্তব্য উঠে আসে। বৈঠকে ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকে থাকা একাধিক সিনিয়র নেতার মতে, রাখাইন রাজ্যে চলমান যুদ্ধাবস্থা ও সামরিক জান্তার দমন-পীড়নের মধ্যে এ ধরনের করিডোর খোলা হলে তা বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাগতভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিএনপি সিদ্ধান্ত নেয়, রাখাইনে সম্ভাব্য মানবিক করিডোর খোলার পেছনে সরকারের উদ্দেশ্য, প্রক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক অবস্থান বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করবে। দলটি তাদের ১২-দলীয় মিত্র জোটের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সমন্বিত অবস্থান গ্রহণের চিন্তা করছে। এ ছাড়া রাখাইনের বাস্তব পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করবে বিএনপি। বিশেষ করে ভারত ও চীনের অবস্থান এবং জাতিসংঘ ও আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর ভূমিকা পর্যবেক্ষণের পরিকল্পনা নিয়েছে দলটি।
বিএনপি বলছে, সরকারের এ সিদ্ধান্ত গোপনীয়তার সঙ্গে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো আলোচনাবিহীনভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এ প্রসঙ্গে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, "আমরা এখনো পুরোপুরি জানি না, সরকার কীভাবে এই করিডোর দেবে। শর্ত কী—তাও পরিষ্কার নয়। পত্রিকায় পড়েছি মাত্র। জনগণের প্রতিনিধিত্ব ছাড়া একটি সরকার দেশের নিরাপত্তা নিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত কীভাবে নেয়, সেটি আমাদের বোধগম্য নয়।"
তিনি আরও বলেন, "রাখাইনে বর্তমানে যে মানবিক বিপর্যয় চলছে, আমরা সেটি অস্বীকার করছি না। কিন্তু দেশের সার্বভৌমত্ব, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক কূটনৈতিক ভারসাম্য বিবেচনায় না নিয়ে করিডোর খোলা গেলে এর প্রতিক্রিয়া ভয়াবহ হতে পারে। জাতিকে এর খেসারত দিতে হতে পারে। তাই সরকারকে এই বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে—কী প্রক্রিয়ায়, কী শর্তে এই করিডোর খোলা হচ্ছে, এবং সেটি কে পরিচালনা করবে।"
বৈঠকে উপস্থিত আরও একাধিক নেতার মতে, রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও আরাকান আর্মির মধ্যে বর্তমানে যে তীব্র লড়াই চলছে, তার মধ্যে করিডোর খোলার সিদ্ধান্ত কেবল মানবিক নয়, রাজনৈতিকও বটে। কারণ, আরাকান আর্মিকে বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল করতে জান্তা সরকার সব রকম রসদ সরবরাহ বন্ধ করে রেখেছে। এখন বাংলাদেশ করিডোর খুললে এই উত্তেজনার অংশ হয়ে পড়তে পারে এবং সেই পথে চললে ভবিষ্যতে সীমান্ত সংকট আরও গভীর হতে পারে।
বিএনপির নেতারা আরও বলেন, শেখ হাসিনার সরকারের সময়েই বাংলাদেশে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। এই বিশাল সংখ্যক উদ্বাস্তুর বোঝা এখনও বহন করতে হচ্ছে জাতিকে। রাখাইনে দুর্ভিক্ষ এবং মানবিক বিপর্যয়ের কথা বলা হলেও করিডোর খোলার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার মতো আরেকটি জটিল সংকট সৃষ্টি না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
বিএনপির মতে, এই পদক্ষেপে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, করিডোর খোলা হলে তা শুধুমাত্র একটি মানবিক প্রচেষ্টা নয় বরং একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত হিসেবেই আন্তর্জাতিক মহলে মূল্যায়িত হবে। সেখানে জাতিসংঘ, আঞ্চলিক শক্তি এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সমন্বয় ব্যতীত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে।
বিএনপি আরও বলেছে, সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত গ্রহণ করে, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাখাইনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নিলে ভবিষ্যতে জনগণকেই এর দায় বহন করতে হবে। তাই তারা এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পর জাতির সামনে দলীয় অবস্থান উপস্থাপন করবে এবং সরকারের একতরফা সিদ্ধান্তের অপকারিতা তুলে ধরবে।
এই ইস্যুতে শিগগিরই বিএনপি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য গঠনের জন্য উদ্যোগ নেবে বলেও বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। দলটির ভাষ্য, এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের ম্যান্ডেট ও অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গ্রহণযোগ্য নয়।
এই প্রসঙ্গে স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, "জাতীয় নিরাপত্তা ও সীমান্তনীতি একতরফা সিদ্ধান্তে নির্ধারিত হতে পারে না। এই ইস্যুতে সরকারের স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক সংলাপ ও আন্তর্জাতিক কূটনীতির ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি।"
বাংলাবার্তা/এমএইচ