
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের সংস্কার প্রক্রিয়া গত কয়েক বছরে ব্যাপক আলোচনার বিষয় হলেও, বাস্তবে দলের অভ্যন্তরীণ সংস্কার কার্যক্রমে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংবিধান, রাষ্ট্রের নীতি, এবং নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে নানা আলোচনা হলেও, দলীয় স্তরে গণতান্ত্রিক সংস্কারের তেমন কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। যদিও রাজনৈতিক নেতারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণের দাবি করেন, অধিকাংশ দল এখনও একক নেতার কর্তৃত্বের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ উল্লেখ করেন যে, ২০০৭ সালের ১/১১-এর সময় থেকে রাজনৈতিক দলের সংস্কারের আলোচনার মূল বিষয় ছিল দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র। তবে তার মতে, দলগুলোর নিজেদের মধ্যে কার্যত কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতারা এখনও এককভাবে দলের নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণ করে, যা তাদের অভ্যন্তরীণ নির্বাচন ও নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়া থেকে বিরত রাখে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন দাবি করেন, তাদের দল অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে দলের কার্যক্রমের বাইরে থেকে এই উদ্যোগগুলি কতটা কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীও একই ধরনের দাবি করলেও, সেখানে নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রকাশ্যে না হওয়ায় দলের বাইরের কেউ সেগুলি পর্যবেক্ষণ করতে পারে না।
এখনো পর্যন্ত দলের সম্মেলন, নির্বাচনী প্রক্রিয়া কিংবা নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কোনো দৃশ্যমান প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে বিএনপিতে দীর্ঘ সময় ধরে কোন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি, এবং দলটি কার্যত তারেক রহমানের একচ্ছত্র ক্ষমতায় পরিচালিত হচ্ছে। যদিও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, তবে শীর্ষ নেতা শেখ হাসিনার পতনের পর, দলটি আবারও শীর্ষ নেতার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে ফিরে যায়।
বিভিন্ন ছোট দলগুলোর মধ্যে, বিশেষত জামায়াত, জাতীয় পার্টি এবং অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলগুলোতে একই রকম পরিস্থিতি বিরাজমান। এর মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখনও তাদের গঠনতন্ত্র নির্ধারণ করতে পারেনি, এবং সিপিবি ছাড়া অধিকাংশ বাম দলও এখনও ব্যক্তিগত নেতৃত্বকেন্দ্রিক সংগঠনের মতো পরিচালিত হচ্ছে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক মনে করেন, দলগুলোর মধ্যে কিছু পরিবর্তনের উপলব্ধি রয়েছে, এবং গঠনতন্ত্র ও দলের পরিচালনায় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করেন। তার মতে, দলীয় সংস্কার ছাড়া রাষ্ট্রীয় সংস্কার টেকসই হবে না। তিনি জানান, দলের মধ্যে গণতন্ত্র ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যা বর্তমানে বেশিরভাগ দলের মধ্যে অনুপস্থিত।
মহিউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এখনও প্রকৃত রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। তিনি মনে করেন, ১/১১-এ যে রাজনৈতিক সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা দেখা গিয়েছিল, তা এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। দলগুলো ব্যক্তি বা পরিবারকেন্দ্রিক সিন্ডিকেটে পরিণত হয়েছে, এবং এর ফলে তাদের মধ্যে কোনো ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি নির্বাচনে তাদের ভোটের অধিকার চাওয়া হলেও, দলের অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো পরিবর্তন আসছে না।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। সেই সময় নির্বাচনী প্রক্রিয়া, দলীয় গণতন্ত্র এবং শীর্ষ নেতৃত্বের নির্বাচনে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। তবে পরে সেই উদ্যোগগুলি বাস্তবায়নে তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। যদিও কিছু দল তাদের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করেছিল, কিন্তু বাস্তবে শীর্ষ নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে একই পুরনো প্রক্রিয়া আবারও ফিরে এসেছে।
২০০৭ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করার পর থেকে কিছু আইনি কাঠামো তৈরি হয়েছিল। তবে বাস্তবে রাজনৈতিক দলগুলো এখনও তাদের দলের অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ, ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব, এবং তৃণমূল ভোটের মাধ্যমে প্যানেল নির্বাচন বিষয়ক বিধানগুলি যথাযথভাবে অনুসরণ করেনি। রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্র সম্পর্কে সরকারের নীতির কোনো সুস্পষ্ট বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক সংস্কারের উদ্যোগগুলো এখনো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দৃশ্যমান হয়নি।
বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, যদি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং নির্বাচন কমিশন দৃঢ়ভাবে পদক্ষেপ নেয়, তবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তবে দলের অভ্যন্তরীণ সংস্কার এবং দলের শীর্ষ নেতার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতি বদলানোর জন্য আরও সময় প্রয়োজন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ