
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপের হুমকি এবং সম্ভাব্য বাণিজ্যিক চাপের মুখে বাংলাদেশ সরকার কৌশলী অবস্থান নিচ্ছে। বুধবার (৩০ এপ্রিল) রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে অনুষ্ঠিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং এফবিসিসিআই-এর (ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি) যৌথ আয়োজিত ৪৫তম পরামর্শক কমিটির সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এসব কথা বলেন।
তিনি স্পষ্ট জানান, বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসায়িক আলোচনায় অনমনীয় হবে না, বরং সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান খোঁজার নীতিতেই অটল রয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে চটাতে চাই না। পাল্টা শুল্ক নিয়ে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষি করব। আলোচনার জন্য আমাদের হাতে এখনো ৯০ দিন সময় রয়েছে। এর মধ্যে সমাধান না হলে, আমরা প্রয়োজনবোধে আরো সময় চাইব।”
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি অনুযায়ী বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টা শুল্ক নিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য অঙ্গনে একধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা চাই যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে যে এই শুল্কের কারণে আমাদের রপ্তানি খাত—বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প—মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আমরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি এবং প্রয়োজনে আরো সময় চাইবো।”
তিনি আরও বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। একতরফা সিদ্ধান্ত না নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে চাই।”
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি বাস্তবায়িত হলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে। আমাদের ব্যবসায়ীদের আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক হতে হবে। বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে পণ্যের মান, সেবা এবং উৎপাদন ব্যয়ের দিক থেকে সক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই।”
তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, কোনো একটি দেশ যখন নিজেদের বাজার রক্ষায় আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দেয়, তখন সেই দেশের ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত আলোচনার মাধ্যমে বোঝাপড়ায় পৌঁছানো।
সভায় আইএমএফের ঋণ সংক্রান্ত একটি প্রশ্নের জবাবে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, “আমরা আইএমএফের ঋণ নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নই। সামষ্টিক অর্থনীতিতে ইতোমধ্যে কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছে। রাজস্ব আয় বাড়ছে, এবং সরকার ঘাটতি মেটাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “কর ছাড় বা রেয়াতের যুগ শেষ। এখন রাজস্ব বাড়াতেই হবে। কারণ, সরকার চালাতে হলে অর্থের প্রয়োজন। যে খাতে রেয়াত দেওয়া হবে, সেখান থেকে আয় বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে কোনো খাতেই অপ্রয়োজনীয় কর ছাড় দেওয়া হবে না।”
তিনি বাজেট প্রসঙ্গে বলেন, “আমরা এমন বাজেট দেব যেটা বাস্তবায়নযোগ্য। প্রত্যাশার ফুলঝুড়ি বাজেটে থাকবে না। বাজেট হবে প্রেক্ষাপটভিত্তিক এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে সম্মান জানিয়ে তৈরি।”
বক্তব্যে ড. সালেহউদ্দিন আরও বলেন, “বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিবিড় আলোচনায় রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে বহুপাক্ষিক সহযোগিতা এবং বিনিয়োগ সংক্রান্ত চুক্তিগুলোর বিষয়েও অগ্রগতি হচ্ছে।”
তিনি জানান, “বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, আইএমএফ, এফএটিএফসহ বিভিন্ন সংস্থার পরামর্শ গ্রহণ করে আমাদের আর্থিক নীতিমালা উন্নত করা হচ্ছে। তাদের চাপ থাকলেও আমরা তা পরিচালনা করছি আমাদের জাতীয় স্বার্থ বজায় রেখেই।”
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান সভায় সভাপতিত্ব করেন। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক মাহমুদ বিন হারুন, এফবিসিসিআই প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান, এনবিআর কর্মকর্তাবৃন্দ এবং ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ।
উল্লেখযোগ্য যে, বৈশ্বিক বাণিজ্য যুদ্ধের এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ একদিকে যেমন কূটনৈতিক আলোচনায় সক্রিয়, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব ব্যবস্থাও শক্তিশালী করতে সচেষ্ট। এই দুই প্রান্তে সমন্বিত পদক্ষেপই ভবিষ্যৎ অর্থনীতির গতিপথ নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ