ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে—এমন এক সময়ে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের দিকে এগোচ্ছে সরকার, যখন দেশের অর্থনীতি নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কর আদায়ে দীর্ঘদিনের অদক্ষতা, রাজস্ব-জিডিপি অনুপাতের ভঙ্গুর অবস্থা, এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ভোগা এনবিআরের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ছিলই—এখন সেটির সম্ভাব্য সমাধান হিসেবেই 'রাষ্ট্রীয় নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ-২০২৫'র খসড়া সামনে এসেছে। কিন্তু এই খসড়া প্রকৃতপক্ষে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি রাখছে, নাকি এক নতুন আমলাতান্ত্রিক গোলকধাঁধায় দেশকে ফেলছে—তা নিয়ে শুরু হয়েছে গভীর বিতর্ক।
এনবিআরের ব্যর্থতার পটভূমি
বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন, বিশ্বের দৃষ্টিতেও এটি অত্যন্ত দুর্বল। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক বারবার এই অনুপাত বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। বিশেষ করে, ২০২৩ সালে অনুমোদিত আইএমএফ ঋণপ্যাকেজের অন্যতম শর্ত ছিল কর কাঠামো সংস্কার। বিশ্বব্যাংক তার সর্বশেষ বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেটেও একই সুপারিশ করেছে—কর নীতি, প্রশাসন ও প্রয়োগ যেন আলাদা করা হয়।
সরকার এই প্রেক্ষাপটে এনবিআর ভেঙে গঠন করতে চায় দুটি নতুন বিভাগ—রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ। পূর্বের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও এনবিআর বিলুপ্ত হবে। কিন্তু এটি হবে আদৌ কার্যকরী সংস্কার, নাকি নতুন নামধারী পুরোনো জটিলতা—এই প্রশ্ন এখন সামনে চলে এসেছে।
খসড়া অধ্যাদেশ: সুযোগ না ফাঁদ?
খসড়ায় বলা হয়েছে, রাজস্ব নীতি বিভাগ থাকবে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে, যার নেতৃত্বে থাকবেন একজন সচিব বা সিনিয়র সচিব। একইভাবে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ দেখবে কর আদায় ও প্রয়োগ। সমস্যার সূচনা এখান থেকেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন বিভাগ প্রধানদের নিয়োগের শর্তে 'রাজস্ব বিষয়ে অভিজ্ঞতা'র কোনো কঠোর মানদণ্ড নেই। এতে রাজনৈতিক পছন্দ বা আমলাতান্ত্রিক জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগের শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্নেহাশীষ বড়ুয়া মনে করেন, 'একটি প্রতিষ্ঠানে নীতি নির্ধারণ, প্রয়োগ ও মূল্যায়ন একসঙ্গে করলে স্বচ্ছতা নষ্ট হয়। স্বাধীন নীতি বিভাগ স্বচ্ছতা আনবে, কিন্তু বাস্তবায়ন যদি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে রূপ পায় তাহলে উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে।'
অর্থ মন্ত্রণালয়ের গঠিত উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ও সাবেক কাস্টমস সদস্য ফরিদ উদ্দিন আরও স্পষ্ট করে বলেন, 'খসড়ার সঙ্গে আমাদের সুপারিশের বিস্ময়কর ফারাক। যারা স্ট্যাম্প ডিউটি দেখেছেন তাঁরা আজ রাজস্ব বিশেষজ্ঞ হতে পারেন—এই বিধান বিপর্যয় ডেকে আনবে।'
উপদেষ্টা কমিটির অসন্তোষ
অর্থ মন্ত্রণালয় যে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছিল, তাদের স্পষ্ট প্রস্তাব ছিল—রাজস্ব ক্যাডার বা সমমানের অভিজ্ঞতা ছাড়া কাউকে এই নতুন বিভাগ প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। রাজস্ব বিষয়ে ন্যূনতম দক্ষতা, আন্তর্জাতিক কর কাঠামো সম্পর্কে ধারণা ও আইনগত দক্ষতাকে মূল্য দিতে হবে। খসড়ায় এসব উপেক্ষিত হওয়ায় ফরিদ উদ্দিন ও আরেক সদস্য আমিনুর রহমান প্রকাশ্যে সমালোচনায় মুখর হয়েছেন।
তাদের মতে, এই খসড়া প্রয়োগ হলে পুরো রাজস্ব ব্যবস্থা আবারও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব ও রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতার নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। আমিনুর রহমান বলেন, 'আমাদের চাওয়া ছিল একটি স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত কাঠামো। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এটি নতুনভাবে পুরোনো পদ্ধতির পুনরাবৃত্তি।'
সমিতিরা কী বলছে?
বিসিএস ট্যাক্সেশন অ্যাসোসিয়েশন ও কাস্টমস-ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশন যৌথ বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, নীতিনির্ধারণী স্তরে রাজস্ব ক্যাডারদের না আনলে নীতি ও বাস্তবতার মধ্যে বড় ব্যবধান তৈরি হবে। এতে রাজস্ব সংস্কারের মূল লক্ষ্য বিঘ্নিত হবে।
তারা মনে করছেন, যদি নীতি বিভাগকে প্রশাসন বিভাগের কাজ তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে আইনগত দ্বন্দ্ব তৈরি হবে। এই দ্বৈত ক্ষমতার ব্যবস্থায় প্রশাসনের কার্যক্রম দুর্বল হতে পারে, আর নীতির বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে।
ফল নির্ভর করছে বাস্তবায়নের ওপর
শ্বেতপত্র প্যানেলের সদস্য অধ্যাপক আবু ইউসুফ এবং র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক ইউসুফ বিশ্বাস করেন, এই উদ্যোগ যুগোপযোগী হতে পারে যদি এটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়। ‘উদ্দেশ্য ভালো, তবে প্রয়োগে দক্ষতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, 'আমরা দীর্ঘদিন ধরে পরোক্ষ কর নির্ভর। এটা পরিবর্তন দরকার। প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হলে দক্ষ ও স্বাধীন নীতি বিভাগ গঠন অপরিহার্য। কিন্তু যদি পুরনো ধাঁচে নিয়োগ হয় এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় লোক বসানো হয়, তাহলে এটা হবে রাজস্ব সংস্কারের নামে নতুন অচল কাঠামো গড়া।'
এনবিআর ভেঙে দুটি বিভাগ গঠন একটি নীতিগত পরিবর্তন—এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এটি সংস্কার না বিভ্রান্তি—সেটি নির্ধারিত হবে কে নিয়োগ পান, কীভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কতটা কমানো যায়, তার ওপর। কাগজে কলমে এই উদ্যোগ আধুনিক ও সময়োপযোগী হলেও, বাস্তবায়নে যদি স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দক্ষতা না থাকে, তাহলে এটি হবে পুরোনো সংকটের নতুন সংস্করণ মাত্র।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



