
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বহুল আলোচিত সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে প্রবল ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের মাঠ পর্যায়ে কর্মরত ছয় হাজারের বেশি নন-ক্যাডার কর্মকর্তা। তাদের অভিযোগ, এনবিআর সংস্কার এবং পৃথকীকরণ উদ্যোগে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের কোনো ধরনের মতামত বা পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি। অথচ তারাই প্রত্যক্ষভাবে রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এভাবে মূল অংশীদারদের বাদ দিয়ে যেকোনো সংস্কার প্রক্রিয়া গ্রহণ করা চরম বৈষম্যমূলক, অগভীর এবং বাস্তবতার সাথে সংগতিহীন।
জরুরি সভায় ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ
সোমবার বিকেলে বাংলাদেশ কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাকাএভ) এবং আয়কর পরিদর্শকদের সংগঠন আয়োজিত জরুরি সভায় এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। নেতারা জানান, এনবিআর সংস্কার এবং দুইভাগে বিভক্ত করার প্রক্রিয়াকে তারা স্বাগত জানালেও, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মতামত উপেক্ষা করায় হতাশা প্রবল। তাদের বক্তব্য, সংস্কার বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের কাঁধে পড়বে। অথচ তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনাই করা হয়নি। ফলে কার্যকর বাস্তবায়নের পথ আরও কঠিন হয়ে উঠবে।
"রাজস্ব আহরণে প্রধান ভূমিকা মাঠ পর্যায়ের, অথচ সিদ্ধান্তে নেই অংশগ্রহণ"
নেতারা প্রশ্ন তোলেন, যে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাজস্ব সংগ্রহের প্রধান হাতিয়ার, তাদের মতামত বাদ দিয়ে নীতিগত পরিবর্তন কীভাবে কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হবে?
তাদের মতে, যদি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে খোলামেলা আলোচনা হতো, তাহলে এনবিআর সংস্কার প্রস্তাব আরও বাস্তবমুখী হতো। এতে সম্ভাব্য সমস্যাগুলো আগাম চিহ্নিত করা যেত, এবং রাজস্ব আদায়ে ঝুঁকি কমানো সম্ভব হতো।
বিশেষ করে তারা উল্লেখ করেন, পৃথক এনবিআর গঠনের পর কী ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন আসবে, রাজস্ব আহরণে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে, কিংবা মাঠ পর্যায়ে নতুন করে কী ধরনের প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ ও সহায়তার প্রয়োজন হবে – এসব বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
রেশন, ঝুঁকি ভাতা, আবাসন সুবিধা নিয়ে দাবির পুনরুল্লেখ
সভায় কর্মকর্তারা রাজস্ব বিভাগের কর্মীদের জন্য রেশন, ঝুঁকি ভাতা, আবাসন সুবিধা, যানবাহন বরাদ্দ বৃদ্ধি, বদলি নীতিমালা, প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তার কথা আবারও জোর দিয়ে বলেন। তাদের মতে, রাজস্ব বিভাগের কর্মীদের ন্যায্য সুবিধা নিশ্চিত করা ছাড়া স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অর্জন সম্ভব নয়।
তারা বলেন, “রাজস্ব খাত রাষ্ট্রের অক্সিজেন। অথচ এই খাতের কর্মীদের যখনই ন্যায্য দাবির কথা আসে, তখন নানা অজুহাত দিয়ে উপেক্ষা করা হয়।”
সংস্কার কমিশনের কার্যপ্রণালীতেও অসন্তোষ
নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, অন্যান্য খাতে সংস্কার কমিশন সংশ্লিষ্ট সব পর্যায়ের মতামত বিবেচনায় নিলেও এনবিআর সংস্কার কমিশন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী আচরণ করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া খসড়া অধ্যাদেশের বেশ কিছু প্রস্তাব তাদের মতে বাস্তবতার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বর্তমান মাঠ পর্যায়ের চ্যালেঞ্জের প্রতিফলন ঘটায় না।
কর্মকর্তারা প্রশ্ন তুলেছেন, “একটি সংস্থা যদি মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সংস্কার প্রস্তাব তৈরি না করে, তাহলে তার উদ্দেশ্য কতটা অন্তঃসারশূন্য হবে?” তারা আরও বলেন, এ ধরনের সংস্কার বাস্তবায়নের ফলে রাজস্ব সংগ্রহে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
এনবিআর আলাদা করার আগে সব আইনি কাঠামো ও সুবিধা পুনর্বিন্যাস জরুরি
কর্মকর্তারা মনে করেন, শুধু এনবিআর দুইভাগে ভাগ করলেই রাজস্ব ব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন আসবে না। বরং জরুরি প্রয়োজন রয়েছে - সব আইনি কাঠামো যুগোপযোগীকরণ, মাঠ পর্যায়ের রেশন সুবিধা বৃদ্ধি, ঝুঁকি ভাতা প্রদান, আবাসন সমস্যা সমাধান, বদলি নীতিমালার স্বচ্ছতা, প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ এবং সুনির্দিষ্ট ক্যারিয়ার প্ল্যানিংয়ের।
তাদের ভাষায়, “মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ন্যায্য সুবিধা ও সম্মান নিশ্চিত না করে সংস্কার করলে সেটা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে। বাস্তবে তার সুফল আসবে না।”
পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি নিয়েও প্রশ্ন
সরকার গঠিত পাঁচ সদস্যের এনবিআর সংস্কার উপদেষ্টা কমিটি নিয়ে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে কিছুটা হতাশা রয়েছে। এই কমিটির সব সদস্যই এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা, যার মধ্যে দুজন সাবেক চেয়ারম্যান। কর্মকর্তাদের প্রশ্ন, যারা অতীতে রাজস্ব খাতে সংস্কারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আনতে পারেননি, তারা বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন করে কীভাবে যুগোপযোগী সংস্কার নিশ্চিত করবেন?
বিশেষ করে বর্তমান সময়ের ডিজিটাল ট্যাক্সেশন, ট্রান্সফার প্রাইসিং, ই-ভ্যাট, রিস্ক বেসড অডিটিং ইত্যাদি চ্যালেঞ্জের কথা বিবেচনায় এনে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞ ও কর্মরত কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করার দাবি জোরালোভাবে উঠে আসে।
এনবিআর সংস্কারকে কেন্দ্র করে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তারা মনে করেন, প্রকৃতপক্ষে রাজস্ব ব্যবস্থার টেকসই উন্নয়নের জন্য সব স্তরের কর্মকর্তাদের মতামত ও বাস্তব অভিজ্ঞতা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা অপরিহার্য। নতুবা এই সংস্কার প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদে রাজস্ব ব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাবার্তা/এসজে