
ছবি: সংগৃহীত
রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে জামিন পেয়েছেন বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের সাবেক মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস। ৩০ এপ্রিল (বুধবার) হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ এই জামিন মঞ্জুরের আদেশ দেন। বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমান ও বিচারপতি মো. আলী রেজা সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে এ আদেশ দেন।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন প্রশ্নে রুলের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয় হাইকোর্টে। মামলাটিতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আবদুল বাসেত ও ফরিদ উদ্দিন খান। অন্যদিকে চিন্ময়ের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অপূর্ব কুমার ভট্টাচার্য।
মামলার শুনানিতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফরিদ উদ্দিন আদালতকে জানান, রাষ্ট্রপক্ষ মামলার তদন্ত সংক্রান্ত কিছু হালনাগাদ তথ্য উপস্থাপন করতে এক সপ্তাহ সময় চেয়েছিল, যা আদালত মঞ্জুর করেছিলেন। এরপরই চূড়ান্ত শুনানির জন্য ৩০ এপ্রিল দিন ধার্য করা হয়।
এর আগে গত ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট চিন্ময়ের জামিন চেয়ে করা আবেদনের শুনানি নিয়ে রুল জারি করেছিলেন। এতে আদালত জানতে চান, কেন তাকে জামিন দেওয়া হবে না। এই রুলটি ওঠে গত ১৯ মার্চ আদালতের কার্যতালিকায়। তখন শুনানির জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়, যার ধারাবাহিকতায় ২৩ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষ শুনানি মুলতবি করতে আবেদন জানায় এবং আদালত শুনানি পিছিয়ে দেন।
চিন্ময়ের আইনজীবী অপূর্ব কুমার ভট্টাচার্য এ প্রসঙ্গে বলেন, তার মক্কেল গুরুতর অসুস্থ। এই কারণেই আদালতের কাছে জামিনের আবেদন জানানো হয়। রাষ্ট্রপক্ষ সময় চাওয়ার পরও আদালত নির্ধারিত সময়ে শুনানি গ্রহণ করেন এবং জামিন মঞ্জুর করেন।
চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও থানাধীন মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খান গত বছরের ৩১ অক্টোবর কোতোয়ালি থানায় একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করেন। মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসসহ মোট ১৯ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। পরে ফিরোজ খানকে বিএনপি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, অভিযুক্তরা রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থেকে রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা বিনষ্টের অপচেষ্টা চালিয়েছেন এবং সরকারের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন। মামলার পরপরই চিন্ময়সহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর চিন্ময় দাসের জামিন আবেদন গত বছরের ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে উপস্থাপন করা হলে আদালত তা নামঞ্জুর করেন। এরপরই আদালত প্রাঙ্গণে সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ওইদিন আদালত চত্বরে আইনজীবীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে এবং এই সংঘর্ষে আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে নির্মমভাবে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
ঘটনাটি দেশজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। পরদিন জামিন শুনানির জন্য দিন নির্ধারিত থাকলেও সহকর্মী আইনজীবীর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আইনজীবীরা কর্মবিরতির ডাক দেন, ফলে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। আদালত পরে ৩ ডিসেম্বর পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন, কিন্তু চিন্ময়ের কোনো আইনজীবী সেদিন উপস্থিত ছিলেন না। এরপর আদালত শুনানির পরবর্তী দিন নির্ধারণ করে ২ জানুয়ারি, এবং সেদিন আবারও জামিন আবেদন নামঞ্জুর হয়।
চট্টগ্রামে জামিন আবেদন নামঞ্জুর হওয়ায় চিন্ময়ের পক্ষে হাইকোর্টে আবেদন করা হয় ১২ জানুয়ারি। হাইকোর্ট ৪ ফেব্রুয়ারি শুনানিতে রুল জারি করেন। এরপর বিভিন্ন শুনানি, সময় প্রার্থনা এবং কজলিস্টে একাধিকবার বিষয়টি উঠার পর অবশেষে ৩০ এপ্রিল আদালত জামিন মঞ্জুর করেন।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ছিলেন বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ বলে অনেকেই দাবি করেছেন। অন্যদিকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং রাষ্ট্রপক্ষ বরাবরই বলেছে—চিন্ময়ের বক্তব্য এবং কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রবিরোধী ছিল, যা বিচারসাপেক্ষ।
এখন প্রশ্ন উঠছে, সহিংসতার মধ্য দিয়ে যে মামলা এতদূর গড়িয়েছে, তার ভবিষ্যত কী? চিন্ময়ের জামিনপ্রাপ্তি কি কেবল স্বাস্থ্যগত বিবেচনায়, না কি তদন্তের দুর্বলতার কারণে?
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় জামিনপ্রাপ্ত হলেও চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম চলমান থাকবে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আদালত কর্তৃক তার ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হতে পারে। তবে এ জামিন আদেশ একদিকে যেমন চিন্ময়ের পরিবার ও অনুসারীদের জন্য স্বস্তি, অন্যদিকে এটি রাষ্ট্রপক্ষের তদন্ত ও মামলার পরিচালনার সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে।