
ছবি: সংগৃহীত
রমজান ও পহেলা বৈশাখ পার হলেও রাজধানী ঢাকার কাঁচাবাজারে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যেন থামছেই না। শীতকালীন সবজির মৌসুম শেষ হতেই গ্রীষ্মকালীন সবজির ঘাটতিতে চরম অস্থিরতা দেখা দিয়েছে বাজারে। এরই মাঝে আবারও বাড়তে শুরু করেছে ব্রয়লার, সোনালি ও দেশি মুরগির দাম। মুরগির বাজারে হঠাৎ করে ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত কেজিতে দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ভোক্তারা।
গরমকাল শুরুতেই সবজির দাম দ্বিগুণ
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, খিলক্ষেত, নয়াবাজার, যাত্রাবাড়ী ও মালিবাগসহ বিভিন্ন কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি সবজির দাম আগের চেয়ে অনেকটাই বেশি। ৬০ টাকার নিচে কোনো উল্লেখযোগ্য সবজি মিলছে না বললেই চলে। কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা রসুল বলেন, “বাজারে সবে উঠতে শুরু করেছে গ্রীষ্মকালীন সবজি। এখনো পুরো সরবরাহ শুরু হয়নি। তাই চাহিদা অনুযায়ী জোগান নেই, যার ফলে দাম বাড়ছে।”
সাপ্তাহিক বাজারদরের হিসাবে, করলা বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজিতে, বেগুন ও বরবটি ৭০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০ টাকা, কচুর লতি ৭০ টাকা, কাঁকরোল ১০০ টাকা, ঢ্যাঁড়শ ৫০ টাকা, ঝিঙে ৭০ টাকা ও টমেটো ৩০ টাকা কেজিতে। পেঁপে কেজিতে ৭০ টাকা, গাজর ৪০ টাকা, শসা ৫০ টাকা, পটোল ৫০-৬০ টাকা ও সজনে ডাটা প্রতি কেজি ১২০ থেকে ১৪০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। চালকুমড়া ও লাউ বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকায় প্রতিটি।
খিলক্ষেত বাজারের আনিস নামের এক বিক্রেতা বলেন, “এ সময়ে প্রতিবছরই পেঁপের দাম বাড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁপের দাম বেড়েছে ২০ টাকা। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়।”
বাজারে ধনেপাতা ও কাঁচামরিচের দামও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রতিকেজি কাঁচামরিচ ৮০ থেকে ১০০ টাকা ও ধনেপাতা ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি বিক্রেতারা জানান, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের কারণে খেতের ধনেপাতা ও মরিচ পচে যাওয়ায় সরবরাহ কমে গেছে।
ক্রেতারা বলছেন, ‘সিন্ডিকেটই মূল কারণ’
বাজারে আসা অনেক ক্রেতা এই মূল্যবৃদ্ধিকে কৃত্রিম ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিযোগ করেছেন। ফিরোজ নামের এক ক্রেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “গরম এলেই ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে সবকিছুর দাম বাড়িয়ে দেন। পকেট কাটছে ভোক্তার। সরকারের উচিত এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি বাড়ানো।”
একইসঙ্গে, মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিণী জেসমিন বলেন, “সব জিনিসের দাম বাড়তি, অথচ আয় বাড়েনি। বাজারে গিয়ে শুধু চেয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার নেই।”
মুরগির বাজারে চরম অস্থিরতা
সবজির পাশাপাশি মুরগির বাজারেও দেখা দিয়েছে ব্যাপক অস্থিরতা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে কেজিতে ১০-২০ টাকা, সোনালি মুরগির ক্ষেত্রে তা ১০-৩০ টাকা পর্যন্ত।
কারওয়ান বাজারের মুরগি বিক্রেতা করিম বলেন, “খামারিরা কম মুরগি সরবরাহ করছে। তাই বাজারে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর ফলে দাম বেড়েছে।”
বর্তমানে বাজারে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে কেজিতে ১৮০-১৯০ টাকা, সোনালি ২৭০-২৮০ টাকা, দেশি মুরগি ৬৫০-৬৮০ টাকা, সাদা লেয়ার ২৮০ টাকা, লাল লেয়ার ৩৩০ টাকা এবং হাঁস জাতভেদে ৬০০-৭০০ টাকা পিস দরে বিক্রি হচ্ছে।
ডিমেও আগুন ছোঁয়া দাম
ডিমের বাজারেও ক্রমাগত বেড়েই চলেছে দাম। প্রতি ডজন লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা, সাদা ডিম ১১৫ থেকে ১২০ টাকা, হাঁসের ডিম ১৮০ থেকে ২০০ টাকা এবং দেশি মুরগির ডিম ২২০ টাকায়।
পেঁয়াজের দাম পহেলা বৈশাখ থেকেই চড়া
বাজারে দেশি পেঁয়াজের দামও নতুন করে আলোচনায় এসেছে। হালি পেঁয়াজ কেজিতে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখনো আমদানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে না ঠিকই, তবে দেশি উৎপাদনেও সংকট রয়েছে। সামনে দাম আরও বাড়তে পারে।
কিছুটা স্থিতিশীল: গরুর মাংস, মাছ ও আলু
তবে সামগ্রিক বাজার পরিস্থিতির মধ্যে কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে গরু ও খাসির মাংস এবং মাছের দাম। গরুর মাংস এখনো ৭৫০-৮০০ টাকায়, খাসির মাংস ১২০০ ও ছাগলের মাংস ১১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাছের বাজারে রুই ৩৫০-৪২০ টাকা, কাতল ৩৮০-৪৫০ টাকা, শিং ৫৫০ টাকা, মাগুর ৫০০ টাকা, কৈ ২০০-২৫০ টাকা, কোরাল ৭৫০ টাকা, পাঙাশ ১৮০-২৩০ টাকা ও তেলাপিয়া ১৫০-২২০ টাকায় মিলছে।
আলু এখনও ২০-২২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা অনেকের জন্যই কিছুটা স্বস্তির খবর। তবে আদা ও রসুনের দাম রয়েছে চড়া সীমায়। আদা কেজিতে ১২০ টাকা, দেশি রসুন ৮০-১০০ এবং আমদানিকৃত রসুন ১৮০ থেকে ২২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ: বাজারে তদারকি বাড়ান, সিন্ডিকেট ভাঙুন
অর্থনীতি ও ভোক্তা অধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে চাহিদা ও জোগানের বাস্তব চিত্রের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত মুনাফার আশায় দাম বাড়ানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম বলেন, “ব্যবসায়ীরা গরম, বৃষ্টি, পরিবহন সংকট বা মৌসুম পরিবর্তনের অজুহাত ব্যবহার করে অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়িয়ে দেন। বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের আরও সক্রিয় ভূমিকা দরকার।”
বাজারে নজরদারির দাবি
বাজার পরিস্থিতির এমন অস্থিরতায় নাভিশ্বাস উঠেছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের। যেহেতু খাদ্যদ্রব্যের দাম নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে, তাই ক্রমাগত ভোক্তাস্বার্থ রক্ষায় কঠোর বাজার নজরদারি ও মনিটরিং টিমের কার্যকর পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ