
ছবি: সংগৃহীত
দেশের অন্তর্বর্তী সরকার সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুতি বা কোনো ধরনের পেশাগত প্রতিকূলতার পেছনে রয়েছে—এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন, অযৌক্তিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, সরকার কারো কণ্ঠরোধ করছে না, বরং এই সময়েই বাংলাদেশে বাক-স্বাধীনতার সর্বোচ্চ বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে।
শুক্রবার (২ মে) চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত ‘জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশ: গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনাসভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে শফিকুল আলম এসব কথা বলেন।
প্রেস সচিবের বক্তব্য অনুযায়ী, বর্তমান সরকার সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমকে কখনোই নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেনি। বরং সরকার দেখছে, প্রতিদিন নানা প্ল্যাটফর্মে হাজারো বক্তা নানারকম বক্তব্য দিচ্ছেন, এমনকি মিথ্যাচারও করছেন। তবুও সরকার তাদের মুখ বন্ধ করতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তিনি বলেন,
“বাংলাদেশের ইতিহাসে বর্তমানে মানুষ সবচেয়ে বেশি বাক-স্বাধীনতা ভোগ করছে। আমরা ফেসবুকে দেখছি অনেকেই মিথ্যা খবর ছড়াচ্ছেন, আজেবাজে কথা বলছেন। কিন্তু সরকার কোনো অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেনি বা কোনো সাংবাদিককে দমন করেনি।”
শফিকুল আলম আরও বলেন, “গণমাধ্যমে প্রতিদিন নানা ধরনের লেখা ছাপা হচ্ছে। সরকার কোথাও বলে দেয়নি এই সাংবাদিককে বাদ দাও, তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করো, অথবা এই মিডিয়াকে নিষিদ্ধ করো। বরং আমরা দেখেছি—গত ১৫ বছরে কিছু সাংবাদিক যে ভাষায় সংবাদ পরিবেশন করেছেন, তা অন্য কোনো দেশে হলে সেখানে গণমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হতো। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তা করেনি। কারণ আমরা গণতন্ত্র এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি।”
তিনি অতীত উদাহরণ টেনে বলেন,
“এই দেশে কীভাবে গুম ও খুনকে জাস্টিফাই করা হয়েছে, সেটাও আমরা দেখেছি। গুম এবং ক্রসফায়ারের চেয়ে বড় অপরাধ আর কিছু নেই। কাউকে গুম করা মানে শুধু তাকে নিখোঁজ করা নয়, বরং পুরো সমাজকে ভয়ের চাদরে ঢেকে দেওয়া। আগে যখন সরকার এসব বিষয়ে কথা বলত, তখন সেই কথাগুলো গণমাধ্যমেই প্রচার হতো।”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রসঙ্গেও তিনি স্বচ্ছ বক্তব্য রাখেন। তিনি জানান, “আমরা দেখেছি ডিজিটাল মাধ্যমে অনেকেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা তথ্য ছড়ান, যার ফলে নারী ও শিশুরা বিপদের সম্মুখীন হন। আগে যে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ছিল, সেটা ব্যবহার করে পুরো জাতির কণ্ঠ রোধ করা হয়েছিল। বর্তমান সরকার সেই আইনটি স্থগিত করে একটি নতুন আইন প্রণয়নের পথে, যেখানে সাধারণ নাগরিক থেকে সাংবাদিক—সবার অধিকার রক্ষায় সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকবে।”
এই আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার। তিনি সম্প্রতি সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর এক সংবাদ সম্মেলনের পর তিনটি টেলিভিশন চ্যানেলের তিনজন সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতি এবং একটি চ্যানেলের সাময়িক সংবাদ প্রচার স্থগিতের বিষয়টি প্রসঙ্গে বলেন,
“সরকারের কোনো সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা দায়িত্বশীল ব্যক্তি এসব চ্যানেলকে তাদের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেনি। এটি পুরোপুরি সংশ্লিষ্ট চ্যানেলগুলোর নিজস্ব সিদ্ধান্ত।”
তিনি আরও অভিযোগ করেন, “সরকারকে দোষারোপ করে অনেকেই চ্যানেলগুলোর বেআইনি ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্তকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। অথচ কোনো টেলিভিশন বা মিডিয়া হাউস আনুষ্ঠানিকভাবে এসব সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুতির সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করেনি। কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারকে দায়ী করে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে, যা অনভিপ্রেত এবং দুঃখজনক।”
সভায় আরও অংশ নেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচি, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ শাহনওয়াজ এবং সাধারণ সম্পাদক সালেহ নোমান।
তারা সকলেই বলেন, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা এখন এক বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে গণমাধ্যমের কর্মীদের ব্যবহার করছেন, আবার কেউ কেউ সংবাদ পরিবেশনের স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। এ অবস্থায় সাংবাদিকদের উচিত পেশাগত দায়িত্ববোধ বজায় রেখে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবিচল থাকা।
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের এই সভাটি স্পষ্ট করে দিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যম জগতে ঘটে যাওয়া কিছু আলোচিত ঘটনা নিয়ে যেভাবে সরকারকে দোষারোপ করা হচ্ছে, তা বাস্তবতাভিত্তিক নয়। বরং গণমাধ্যমের ভেতরে থাকা গোপন স্বার্থ ও ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার জেরেই অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
বাংলাবার্তা/এমএইচ