
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রুটে বহুল ব্যবহৃত বেসরকারি বিমান সংস্থা নভোএয়ার হঠাৎ করেই তাদের সকল ফ্লাইট সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। ২০২৫ সালের ২ মে থেকে নভোএয়ারের কোনো ফ্লাইট চলাচল করছে না। এই আকস্মিক স্থগিতাদেশে দেশের ভ্রমণ পছন্দকারীরা এবং নিয়মিত যাত্রীরা চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন।
এয়ারলাইন্সটির অভ্যন্তরীণ সূত্র ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) জানিয়েছে, নভোএয়ার কর্তৃপক্ষ সাময়িক সময়ের জন্য এই স্থগিতাদেশ দিয়েছে এবং দাবি করেছে, দুই সপ্তাহের মধ্যে আবার ফ্লাইট চালু হবে। তবে ঠিক কবে নাগাদ ফ্লাইট পুনরায় চালু হবে, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত কোনো সময়সীমা দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি।
নভোএয়ারের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, সংস্থাটি অনেক দিন ধরেই তাদের বহরে থাকা পাঁচটি এটিআর উড়োজাহাজ বিক্রির চেষ্টা চালিয়ে আসছে। সেই বিক্রির পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিভিন্ন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এসে উড়োজাহাজগুলোর ‘এয়ারক্রাফট ইন্সপেকশন’ করবেন। এ কারণে উড়োজাহাজগুলোকে প্রস্তুত রাখা এবং গ্রাউন্ড ইন্সপেকশনের সুবিধার্থে ফ্লাইট চলাচল আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে।
তবে, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র ইন্সপেকশনের জন্য পুরো বিমান পরিচালনা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেবে—এমন ব্যাখ্যায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। বিশেষ করে, যখন একই ধরনের উড়োজাহাজ থাকা অন্য এয়ারলাইন্সগুলো নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করে যাচ্ছে।
নভোএয়ার হঠাৎ করেই চলতি বছরের এপ্রিলের ২০ তারিখে টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দেয়, যা প্রথমে অনেক যাত্রীর মনে উদ্বেগ তৈরি করেছিল। পরে তারা আবার ঘোষণা দেয়, প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হচ্ছে না, এবং ফের টিকিট বিক্রি শুরু করে। কিন্তু সেই ঘোষণার মাত্র ১০ দিনের মাথায় আবারও টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দেয় নভোএয়ার, এবং এবার সরাসরি ফ্লাইটও বন্ধ করে দেয়।
এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে যেসব যাত্রী আগে থেকেই টিকিট কিনে রেখেছিলেন, তাদের অনেকে বিকল্প কোনো ফ্লাইট পাচ্ছেন না, আবার কেউ কেউ ফেরত পাচ্ছেন না পূর্ণ মূল্য। অন্যদিকে, যেসব অভ্যন্তরীণ রুটে নভোএয়ার নিয়মিত ফ্লাইট চালাত—ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, যশোর, সিলেট, সৈয়দপুর ও রাজশাহী—সেসব রুটে এখন চাহিদা থাকলেও যাত্রী পরিবহনে চাপে পড়েছে অন্য এয়ারলাইন্সগুলো।
নভোএয়ারের একমাত্র আন্তর্জাতিক রুট ছিল ঢাকা-কলকাতা, যা ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে যাত্রী সংকটের কারণে বন্ধ রাখা হয়। তখন সংস্থাটি ঘোষণা দিয়েছিল যে তারা এয়ারক্রাফট বিক্রি করে মাঝারি আকারের উড়োজাহাজ যেমন এয়ারবাস কিনে আন্তর্জাতিক রুটে বড় পরিসরে ফ্লাইট চালাবে।
কিন্তু বাস্তবে তা আর সম্ভব হয়নি। প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ না পাওয়া ও আর্থিক সংকট-এর কারণে প্রতিষ্ঠানটি নতুন উড়োজাহাজ কেনার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বরং বর্তমানে উল্টো তাদের বর্তমান ফ্লিট-ই বিক্রির প্রক্রিয়ায় রয়েছে, যা স্পষ্ট করে দেয় প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক ও পরিচালনাগত অবস্থান দুর্বল।
বর্তমান পরিস্থিতিতে নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমানসহ শীর্ষ কর্মকর্তা কারো সঙ্গেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি বলে গণমাধ্যম জানিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে কোনো প্রেস বিজ্ঞপ্তি বা আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়নি, ফলে যাত্রী, ট্রাভেল এজেন্সি এবং খাত সংশ্লিষ্টরা ধোঁয়াশার মধ্যেই রয়েছে।
উড়োজাহাজ বিক্রির কারণে ফ্লাইট বন্ধ—এই ব্যাখ্যায় সংশয় প্রকাশ করেছেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এটা একটি বড় পরিসরের কাঠামোগত সংকটের ইঙ্গিত দিতে পারে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, নভোএয়ার হয়তো ভবিষ্যতে অপারেশন বন্ধের সিদ্ধান্তে যেতে পারে, যদি তারা যথাযথ বিনিয়োগকারী না খুঁজে পায়।
একসময় অভ্যন্তরীণ রুটে নির্ভরযোগ্য সেবাদাতা হিসেবে পরিচিত নভোএয়ার আজ অনিশ্চয়তায়। এয়ারক্রাফট বিক্রি, আন্তর্জাতিক রুট থেকে পিছিয়ে আসা, ফ্লাইট স্থগিত এবং দায় এড়িয়ে চলা—all মিলিয়ে যাত্রীদের আস্থায় বড় ধাক্কা লেগেছে।
নভোএয়ার কী কেবল সাময়িক ঝিমুনি কাটিয়ে আবারও আকাশে ফিরবে, নাকি এটি একটি বৃহত্তর পতনের শুরু—তা জানতে আগামী দিনগুলোর অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই।
বাংলাবার্তা/এমএইচ