
ছবি: সংগৃহীত
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সঙ্গে উত্তেজনার পারদ চরমে পৌঁছেছে। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বৈরিতা ও নতুন করে কাশ্মির ইস্যু ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতা পরিস্থিতিকে এমন এক মোড় এনে দিয়েছে, যেখানে জলসম্পদ—বিশেষ করে সিন্ধু নদ—নিয়ে সংঘাতের আশঙ্কা আবারো ঘনীভূত হয়েছে। এরই মধ্যে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহম্মদ আসিফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ভারত যদি সিন্ধু নদে পানিপ্রবাহ ব্যাহত করতে কোনো বাঁধ বা অবকাঠামো নির্মাণ করে, তাহলে তা সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণার সামিল হবে এবং পাকিস্তান সামরিক হামলা চালিয়ে সেই স্থাপনা ধ্বংস করবে।
এই হুঁশিয়ারি আসে এমন এক সময়, যখন ভারতের নিয়ন্ত্রণাধীন কাশ্মিরে সাম্প্রতিক একটি ভয়াবহ জঙ্গি হামলার প্রেক্ষিতে নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। দু’পক্ষই একে অপরকে দোষারোপ করছে, আর উভয় দেশের নেতৃত্ব ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো যুদ্ধ সম্ভাবনার দিকেও প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
পাকিস্তানের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম জিও নিউজের ‘নয়া পাকিস্তান’ টেলিভিশন প্রোগ্রামে শুক্রবার (২ মে) রাতে প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেন, “শুধু গুলির শব্দ বা ট্যাংকের গর্জন নয়—পানিপ্রবাহ বন্ধ করাও একধরনের আগ্রাসন। যদি ভারত সিন্ধু নদে বাঁধ নির্মাণ করে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয় বা তা ভিন্নপথে চালিত করার চেষ্টা করে, তাহলে আমরা চুপ করে বসে থাকব না। এটা অস্ত্র ছুঁড়ে হত্যার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।”
তিনি বলেন, “এই নদী থেকে লাখ লাখ মানুষ জীবনধারণ করে। যদি এই পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও তৃষ্ণায় লাখো মানুষ মারা পড়বে। এটা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন, মানবিক অস্তিত্বের প্রশ্ন।”
তিনি আরও বলেন, “যদি নয়াদিল্লি আমাদের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়, আমরা সরাসরি হামলা চালিয়ে সেই বাঁধ বা স্থাপনাকে ধ্বংস করব। তবে আপাতত আমরা আন্তর্জাতিক মহলে বিষয়টি তুলছি, নজর রাখছি, এবং কূটনৈতিক স্তরে আলোচনার চেষ্টা করছি।”
এই সামগ্রিক উত্তেজনার সূচনাবিন্দু ছিল ২২ এপ্রিলের এক ভয়াবহ জঙ্গি হামলা, যা ঘটে ভারতের জম্মু ও কাশ্মিরের পর্যটনকেন্দ্র পেহেলগাঁও জেলার বৈসরণ তৃণভূমিতে। সেখানে কাশ্মিরভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই তৈয়বার সহযোগী সংগঠন ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’-এর সদস্যরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে পর্যটকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়।
এই হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হন, যাঁদের সবাই পুরুষ এবং অধিকাংশই ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আগত। আহত হন আরও বেশ কয়েকজন। এটি ছিল ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর কাশ্মিরে সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা, যা গোটা ভারতজুড়ে তীব্র ক্ষোভ ও জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কের সৃষ্টি করে।
এই হামলার পর ভারত সরাসরি পাকিস্তানকে দোষারোপ করে। প্রতিক্রিয়ায় নয়াদিল্লি সিন্ধু নদের পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিত, পাকিস্তান দূতাবাস থেকে কূটনীতিকদের ফিরিয়ে আনা, পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিল, এবং সীমান্তে সেনা মোতায়েন বৃদ্ধিসহ একগুচ্ছ কূটনৈতিক ও প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ নেয়।
জবাবে ইসলামাবাদও ভারতীয় কূটনীতিকদের বহিষ্কার, পাকিস্তানে অবস্থানরত ভারতীয়দের ভিসা বাতিল, আকাশ ও স্থলপথে যাতায়াত বন্ধ, এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পূর্ণ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
বর্তমানে দুই দেশের সীমান্তে সেনাবাহিনী উচ্চ সতর্কতায় রয়েছে, এবং উভয় পক্ষই যেকোনো মুহূর্তে সংঘর্ষে জড়ানোর আশঙ্কা করছে।
পাকিস্তানি প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ স্পষ্ট বলেন, “এখনও যুদ্ধ এড়াতে পারা গেছে—এমনটা ভাবার সময় আসেনি।” অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি তার সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে ‘কড়া জবাবের’ নির্দেশনা দিয়েছেন, বলে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো উল্লেখ করেছে।
মনে করা হচ্ছে, ভারত সীমিত প্রতিশোধমূলক হামলার পরিকল্পনা করছে এবং এর প্রস্তুতি ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। তবে এই হামলা সংঘটিত হলে পুরো দক্ষিণ এশিয়া একটি সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার সাগরে ঢুকে পড়তে পারে, বিশেষ করে যখন ‘পানি’ এবং ‘সন্ত্রাস’ দুই-ই কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে।
উল্লেখ্য, ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ‘সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি’ (Indus Waters Treaty) স্বাক্ষরিত হয় বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায়। এই চুক্তির আওতায় ছয়টি নদীর মধ্যে তিনটি পশ্চিমা নদী (সিন্ধু, ঝেলম ও চেনাব) পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল এবং বাকি তিনটি (রবি, বিয়াস ও সুতলজ) ভারতের জন্য।
এই চুক্তিকে এতদিন ‘অলিখিত শান্তিচুক্তি’ হিসেবে গণ্য করা হতো, কারণ দু’দেশের মধ্যে বারবার যুদ্ধ হলেও এই পানি চুক্তি কখনও স্থগিত হয়নি। তবে এবার প্রথমবারের মতো তা প্রত্যক্ষভাবে হুমকির মুখে পড়েছে।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ আবারো প্রমাণ করছে, জলসম্পদ এখন আর শুধু পরিবেশগত বা কৃষি সমস্যা নয়—এটি জাতীয় নিরাপত্তা, আঞ্চলিক রাজনীতি ও যুদ্ধনীতি নির্ধারণেও বড় ভূমিকা রাখছে। পাকিস্তানের কড়া হুঁশিয়ারি এবং ভারতের প্রতিশোধপ্রবণ অবস্থান দুই দেশকে এমন এক দিকেই ঠেলে দিচ্ছে, যার শেষ কোথায় গিয়ে ঠেকবে—তা অনিশ্চিত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ