
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ যেন থামছেই না। অবরুদ্ধ এ উপত্যকায় গত ২৪ ঘণ্টায় আরও অন্তত ৪৩ জন নিরীহ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৭৭ জন। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ইসরাইলি সেনাবাহিনী (আইডিএফ) পরিচালিত লাগাতার বিমান হামলা, গোলাবর্ষণ ও ট্যাংক হামলায় এসব প্রাণহানি ঘটে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শুক্রবার রাতে এক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা এ খবর দিয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, নিহতদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। আঘাতপ্রাপ্তদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক, ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গাজার উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে চালানো এসব হামলায় বহু ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। পুড়ে গেছে বাজার, রাস্তাঘাট ও ত্রাণকেন্দ্র। অগণিত মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলার প্রতিক্রিয়ায় শুরু হওয়া ইসরাইলি অভিযান এখনও থেমে যায়নি। ওই দিন সকালে দক্ষিণ ইসরাইলের বিভিন্ন স্থাপনায় আঘাত হানে হামাসের কমান্ডো ইউনিট। এতে ১২০০ ইসরাইলি নিহত হন এবং অন্তত ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। এর জবাবে আইডিএফ একই দিন থেকে গাজায় ‘অপারেশন আয়রন সোর্ড’ নামে যে অভিযান শুরু করে, তা এখন রূপ নিয়েছে ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী এবং ভয়াবহ সামরিক আগ্রাসনে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত দেড় বছরে ইসরাইলি আগ্রাসনে নিহত হয়েছেন মোট ৫২ হাজার ৪১৮ জন ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ১৮ হাজার ৯১ জন। নিহতদের মধ্যে ৫৬ শতাংশই নারী ও শিশু। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ইসরাইল যুদ্ধের নামে সাধারণ জনগণের ওপর ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন একের পর এক লঙ্ঘিত হচ্ছে, অথচ বিশ্ব নেতারা নীরব।
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে গিয়েছিল ইসরাইল। তবে ১৮ মার্চ থেকে ফের নতুন করে গাজায় পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান শুরু করে তারা। দ্বিতীয় দফার এই আগ্রাসনেও মৃত্যু-আহতের সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত হারে। মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, নতুন করে শুরু হওয়া অভিযানে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন অন্তত ২ হাজার ৩৮ জন, আহত হয়েছেন আরও ৫ হাজারের বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই হামলাগুলো মূলত জনঘনত্বপূর্ণ এলাকা, যেমন শরণার্থী ক্যাম্প, হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী এলাকা ও স্কুলগুলোকেই টার্গেট করছে। ফলে হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গাজার প্রায় ৮০ শতাংশ অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। মানুষের কাছে খাদ্য, পানি, ওষুধ বা আশ্রয়ের কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই।
জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, এই যুদ্ধকে ‘শিশু হত্যার যুদ্ধ’ বলা চলে। প্রতিদিন গড়ে ১০০ জন শিশু গাজায় নিহত হচ্ছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে তুলে আনা যাচ্ছে তাদের লাশ। অনেক সময় শিশুদের মরদেহ শনাক্ত করাও সম্ভব হচ্ছে না, কারণ তারা পুড়ে গেছে বা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে গেছে।
ফিলিস্তিনি সাংবাদিক, চিকিৎসক ও মানবিক সংস্থার স্বেচ্ছাসেবীরা জানাচ্ছেন, অনেক পরিবার পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। এমনকি কিছু কিছু এলাকায় একটিও শিশু জীবিত নেই।
গাজায় চলমান হত্যাযজ্ঞের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক আইনী প্রতিষ্ঠান ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত দাবি করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বেশ কয়েকটি সংস্থা একযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে (আইসিসি) দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। যদিও পশ্চিমা দেশগুলোর একাংশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, এখনও ইসরাইলের প্রতি তাদের সমর্থন অব্যাহত রেখেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, পশ্চিমা সমর্থনের কারণে ইসরাইল এভাবে দিনের পর দিন আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করতে পারছে। যুদ্ধের ভয়াবহতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তাও গাজায় পৌঁছাতে পারছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও মানবাধিকার বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজায় ইসরাইল যে নীতি অনুসরণ করছে তা জাতিগত নির্মূল (Ethnic Cleansing) এর শামিল। এক্ষেত্রে শুধু প্রতিরোধ গোষ্ঠীর সদস্য নয়, বরং সাধারণ নারী-শিশুকেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হত্যা করা হচ্ছে। খাদ্য, পানি, চিকিৎসা ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রেখে পুরো অঞ্চলটিকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করা হচ্ছে।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে তারা অনুরোধ জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে, পাশাপাশি মানবিক সহায়তা গাজায় প্রবেশের পথ খুলে দিতে।
গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর চলমান অভিযান আজ শুধু একটি আঞ্চলিক সংঘাত নয়, এটি রূপ নিয়েছে এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে। শিশুদের আর্তনাদ, বিধ্বস্ত হাসপাতালের ধ্বংসাবশেষ আর শোকার্ত মানুষের মিছিল যেন আজ সারা বিশ্বকে নীরবে প্রশ্ন করছে—এই হত্যাযজ্ঞ আর কতদিন? আর কত মৃত্যু হলে বিবেক জাগবে? প্রশ্নটা অনস্বীকার্য, জবাব অনুপস্থিত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ