
ছবি: সংগৃহীত
কাশ্মীর সীমান্তের নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) বরাবর ভারত ও পাকিস্তানের সেনাদের মধ্যে টানা আট রাত ধরে গুলিবিনিময়ের ঘটনায় দক্ষিণ এশিয়ার দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীর মধ্যকার সামরিক উত্তেজনা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (১ মে) রাতেও দুই দেশের সেনাবাহিনী গোলাগুলিতে জড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
যদিও এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি, তবুও সীমান্ত এলাকায় বাস করা সাধারণ মানুষ চরম আতঙ্কে রয়েছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী দাবি করেছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিনা উসকানিতে একতরফাভাবে গুলি ছুঁড়েছে।
ভারতীয় বাহিনীর ভাষ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের দিক থেকে চালানো গুলির লক্ষ্য ছিল কাশ্মীরের কুপওয়ারা, বারামুলা, পুঞ্চ, নওশেরা ও আখনুর অঞ্চলের ভারতীয় পোস্টগুলো। এসব এলাকায় ভারতীয় বাহিনী শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করে রেখেছে এবং অতীতে এখান থেকেই বেশ কিছু সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়েছে।
ভারতের দাবি, সীমান্তের ওপার থেকে পাকিস্তান ছোট অস্ত্র ও স্বয়ংক্রিয় রাইফেল দিয়ে গুলি চালায়। পাকিস্তানের কোনো সরকারি প্রতিক্রিয়া এখনো পাওয়া না গেলেও ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে যে, ভারতীয় বাহিনীও পাল্টা জবাব দিয়েছে এবং সীমান্তজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
কাশ্মীর সীমান্তে এই ধারাবাহিক গোলাগুলির সূত্রপাত ২২ এপ্রিল পেহেলগাঁওয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পরপরই। ওই হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত হয় এবং ভারত দাবি করে, এটি সীমান্তপারের জঙ্গিদের কাজ। হামলার পর দিল্লি একাধিক কঠোর পদক্ষেপ নেয়, যার মধ্যে ছিল ভারত-পাকিস্তান কূটনৈতিক সম্পর্ক অবনতি, আতারি সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দেওয়া, এবং বহুল আলোচিত সিন্ধু পানি চুক্তি একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা।
ভারতের এসব পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে পাকিস্তান পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। ইসলামাবাদ ভারতের বাণিজ্যিক ফ্লাইটের জন্য আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়, ভারতে রপ্তানি-বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়, এমনকি তৃতীয় দেশের মাধ্যমেও আর কোনো বাণিজ্য করতে রাজি নয় বলে জানায়। একই সঙ্গে পাকিস্তান ভারতের পানিবন্ধ করার হুমকির জবাবে কড়া ভাষায় হুঁশিয়ারি দিয়ে জানায়, “যদি পানি আটকে দেওয়া হয়, তবে সেটিকে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হিসেবে ধরা হবে।”
সীমিত এলাকা থেকে শুরু হওয়া গুলিবিনিময় এখন কেবল নিয়ন্ত্রণরেখা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নেই। এনডিটিভির বরাতে জানা যায়, গত মঙ্গলবার পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই গুলির পরিসর আরও বাড়িয়ে জম্মু জেলার আন্তর্জাতিক সীমান্তবর্তী পারগওয়াল সেক্টর পর্যন্ত বিস্তার করেছে।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় সেনাবাহিনী সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানায় এবং দুই দেশের সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কমিউনিকেশন চ্যানেল—হটলাইন ব্যবস্থার মাধ্যমে সামরিক মহাপরিচালক (ডিজিএমও) পর্যায়ে যোগাযোগ হয়। পিটিআইয়ের বরাতে জানা যায়, ওই আলোচনায় ভারত পাকিস্তানকে ‘বিনা উসকানিতে’ গুলি চালানো বন্ধ করার কঠোর বার্তা দেয়।
এদিকে, সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে দীর্ঘসময় ধরে গোলাগুলির আওয়াজে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরপরই মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বাঙ্কার বা গ্রামীণ স্কুলে চলে যাচ্ছে। ছোট শিশু ও বয়স্করা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কৃষকরা জমিতে যেতে পারছেন না এবং স্থানীয় বাজারগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সীমান্তে এই উত্তেজনা শুধু সামরিক নয়, বরং এটি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে অনেক বড় ইঙ্গিতবাহী। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান অবিশ্বাস, দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ এবং কাশ্মীর ইস্যু—সব মিলিয়ে এই সংঘাতের নেপথ্যে বহুস্তরবিশিষ্ট জটিলতা রয়েছে।
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, যদি এই টানাপোড়েন দ্রুত সময়ের মধ্যে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে নিরসন না হয়, তাহলে তা সীমিত গোলাগুলির বাইরে গিয়ে বড় ধরনের সংঘাতে রূপ নিতে পারে। বিশেষ করে পানি চুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নিয়ে একতরফা পদক্ষেপ নেওয়া দুই দেশের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটাতে পারে।
কাশ্মীর সীমান্তে টানা আট রাত ধরে গোলাগুলির ঘটনা কেবল দুই দেশের সামরিক শক্তির প্রদর্শন নয়, বরং এটি দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা ও মানবিক নিরাপত্তার ওপর বড় ধরনের হুমকি। সীমান্ত উত্তেজনা এখন আর শুধু একটি সামরিক ইস্যু নয়, এটি দুই দেশের মানুষের ভবিষ্যতের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও দায়িত্ব রয়েছে দুই পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানানো এবং দ্রুত কূটনৈতিক সংলাপ শুরু করতে উৎসাহিত করার।
বাংলাবার্তা/এমএইচ