
ছবি: সংগৃহীত
ইসরাইলি বাহিনীর অব্যাহত আগ্রাসনে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় নতুন করে প্রাণ হারাল আরও ৩১ নিরীহ ফিলিস্তিনি নাগরিক। বৃহস্পতিবার (১ মে) ভোর থেকে শুক্রবার (২ মে) ভোর পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। একই সময়ে আরও অন্তত ৫৬ জন গুরুতর আহত হয়েছেন।
ফিলিস্তিনের গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া সামরিক অভিযানে গাজায় এখন পর্যন্ত মোট ৫২ হাজার ৪১৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আর আহতের সংখ্যা এক লাখ ১৮ হাজার ৯১ জন ছাড়িয়েছে। শুক্রবার ভোরে প্রকাশিত বিবৃতিতে মন্ত্রণালয় জানায়, হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে, কারণ অনেক মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছেন কিংবা সড়কে পড়ে রয়েছেন যাদের কাছে উদ্ধারকারীরা পৌঁছাতে পারছেন না।
আলজাজিরা জানায়, ইসরাইলি সেনাবাহিনী শুক্রবার ভোরে গাজার বিভিন্ন স্থানে আকাশ ও স্থলপথে ব্যাপক বোমাবর্ষণ চালায়। হামলার লক্ষ্য ছিল গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস, মধ্যাঞ্চলের দেইর আল বালাহ এবং গাজার উত্তরাঞ্চলীয় কিছু শরণার্থী শিবির।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রাতভর তারা বিস্ফোরণের শব্দে আতঙ্কে ছিলেন। খান ইউনিস শহরের আবু হাজ্জাজ এলাকায় একটি বাড়ির উপর বিমান হামলা চালানো হয়, যেখানে অন্তত ৬ জন শিশু নিহত হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে।
জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বারবার গাজায় অব্যাহত এ ধ্বংসযজ্ঞ এবং বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা বন্ধের আহ্বান জানালেও ইসরাইলি বাহিনী তাদের অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর সকালে দক্ষিণ ইসরাইলে আকস্মিক হামলা চালায় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস। হামলায় ১,২০০ জন ইসরাইলি নাগরিক নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। এই ঘটনার জবাবে ইসরাইল সরকার ‘পূর্ণাঙ্গ সামরিক প্রতিক্রিয়া’র অংশ হিসেবে গাজার ওপর সর্বাত্মক বিমান হামলা শুরু করে।
ইসরাইলি প্রতিরোধকে দমন ও হামাসকে নির্মূল করার নামে টানা কয়েক মাস ধরে গাজা উপত্যকায় নির্বিচার বিমান ও স্থল অভিযান চালায় ইসরাইলি বাহিনী। তাদের দাবি ছিল, গাজার বিভিন্ন জায়গায় গোপন সুড়ঙ্গে হামাসের ঘাঁটি রয়েছে, যেগুলোর বিরুদ্ধে অভিযানের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায় তারা।
এই ‘নিরাপত্তা অভিযান’ নামক দীর্ঘস্থায়ী আগ্রাসনের জেরে গাজার জনজীবন চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, এই সময়ের মধ্যে গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ জনগণ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে কিংবা খোলা আকাশের নিচে জীবন কাটাচ্ছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) বলছে, গাজার শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি ও পানিবাহিত রোগে আক্রান্তের হার দ্রুত বেড়ে চলেছে। বহু পরিবার দিনের পর দিন খাবার না পেয়ে দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছে।
চলমান মানবিক সংকটের মধ্যে ২০২৪ সালের ১৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র, মিশর ও কাতারসহ কিছু মধ্যস্থতাকারী দেশের চাপে গাজায় আংশিক যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয় ইসরাইল। ওই সময় দুই মাসের জন্য সামরিক কার্যক্রম স্থগিত রাখার ঘোষণা দেওয়া হলেও, তা বাস্তবে খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
পূর্বঘোষিত সময়ের আগেই, মার্চের ১৮ তারিখ থেকে ফের গাজায় নতুন করে সশস্ত্র অভিযান শুরু করে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী। এই দ্বিতীয় দফা অভিযানে মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে ইতোমধ্যে ২ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন অন্তত ৫ হাজারের বেশি।
ইসরাইলি সামরিক বাহিনী দাবি করছে, তারা এখনো হামাসের ‘প্রধান ঘাঁটি’ ধ্বংস করতে পারেনি, তাই অভিযান বন্ধ করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, ইসরাইল বরং সুপরিকল্পিতভাবে গাজার বেসামরিক জনগণের ওপর গণহত্যামূলক হামলা চালাচ্ছে।
দখলদার বাহিনীর নির্বিচার এই আক্রমণের মধ্যে গাজার অধিকাংশ হাসপাতাল, স্কুল, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র একেবারেই অচল হয়ে পড়েছে। মানবিক সহায়তা প্রবেশ করানো কঠিন হয়ে পড়েছে সীমান্তে নিরাপত্তা বিধিনিষেধের কারণে।
জাতিসংঘ বলছে, গাজার প্রায় ৬০ শতাংশ অবকাঠামো—যেমন বাড়িঘর, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস অথবা অকার্যকর হয়ে গেছে। পরিস্থিতি এতটাই সংকটময় যে আন্তর্জাতিক মহল এটিকে ‘এ যুগের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়’ হিসেবে বিবেচনা করছে।
এদিকে, গাজায় প্রতিদিনের এই রক্তাক্ত হামলা বন্ধে বিশ্বজুড়ে আন্দোলন, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ হলেও, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এখনো পর্যন্ত কার্যকর কোনো স্থায়ী সমাধান বা যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ