
ছবি: সংগৃহীত
দেশের সড়ক-মহাসড়কে প্রতিদিন দুর্ঘটনার হার বাড়ছে, আর তার মধ্যে নতুন একটি কারণ হিসেবে উঠে এসেছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দৌরাত্ম্য। গত বছর সারা দেশে এই ধরনের যানবাহনের কারণে মোট ৮৭০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মৃত্যু হয়েছে ৮৭৫ জনের এবং আহত হয়েছেন ১ হাজার ৭৭৯ জন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অটোরিকশার দুর্ঘটনা বাড়ার কারণ মূলত সরকারী উদ্যোগের অভাব এবং অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে অকার্যকরতা।
যাত্রীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠন গতকাল সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কিত এই তথ্য প্রকাশ করেছে, যা সমাজে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু গতকালও ঢাকার বনশ্রী এলাকায় একটি অটোরিকশার ধাক্কায় দুটি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব দুর্ঘটনার পেছনে প্রধান কারণ হল, ঢাকার রাস্তায় অটোরিকশাগুলোর অবাধ চলাচল এবং তার সাথে সরকারের নিয়ন্ত্রণের অভাব।
এক দুর্ঘটনায় দুই প্রাণহানি
গত বুধবার ঢাকার বনশ্রী এলাকায় একটি অটোরিকশার ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী দুইজন নিহত হন। মিজানুর রহমান, একজন শোরুম ম্যানেজার, ঘটনার সাক্ষী ছিলেন। তিনি বলেন, মোটরসাইকেলের গতি খুব কম ছিল — মাত্র ১০-১৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। তবে, অটোরিকশা বাইকটিকে ওভারটেক করতে গিয়ে ধাক্কা দেয়। এর ফলে মোটরসাইকেল চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যান এবং তার পরপরই পেছন থেকে একটি বাস এসে তাদের উপর দিয়ে চলে যায়। এর ফলে দুইজনের মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন আবদুল্লাহ আল নোমান ও মো. পাভেল, তারা দুজন পরস্পর বন্ধু ছিলেন।
পুলিশের সহায়তা না পাওয়া
তবে, পুলিশ এই ঘটনায় বাসের চালক এবং অটোরিকশা চালককে গ্রেফতার করতে পারেনি। ঘটনার পর খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানিয়েছিলেন, বাসটি জব্দ করা হয়েছে, তবে চালক ও সহকারী পলাতক। অটোরিকশা চালককেও আটক করা সম্ভব হয়নি।
দুর্ঘটনার কারণ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরই) তথ্যমতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এবং অন্যান্য যানবাহনের কারণে সারাদেশে ৯০০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ৫৮২টি ছিল মারাত্মক। বিশেষজ্ঞরা জানান, এই সংখ্যা বাস্তবে আরও বেশি হতে পারে, কারণ অনেক দুর্ঘটনার তথ্য পুলিশের কাছে পৌঁছায় না।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে ৩৭১টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩৭৮ জন নিহত এবং ৭০৯ জন আহত হয়েছেন। এই সংগঠনটি জানায়, প্রতিদিন দেশের নানা অঞ্চলে অন্তত ৩ থেকে ৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, বিশেষ করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে। তবে এসব দুর্ঘটনার বড় অংশই গণমাধ্যমে আসছে না, কারণ ছোট ছোট যানবাহনের দুর্ঘটনা সাধারণত বেশি গুরুত্ব পায় না।
সরকারের ব্যর্থতা
সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বারবার চেষ্টা করলেও, অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ২০০৯ সালে সিটি করপোরেশন আইন সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, তবে বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। ঢাকা শহরের অলিগলি থেকে প্রধান সড়ক পর্যন্ত অটোরিকশাগুলোর অবাধ চলাচল সড়ক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারের উদ্যোগের অভাবের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা এবং সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা সংকটে পড়েছে।
বিগত মাসগুলোতে ঢাকার বনানী ও গুলশানে অটোরিকশা চলাচল নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। গুলশান সোসাইটির পক্ষ থেকে নতুন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে ওই এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলতে পারবে না, কিন্তু রিকশাচালকরা সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেননি। এরপর তাদের সাথে পথচারী ও বাইকারদের সংঘর্ষও ঘটেছে, যা একপ্রকার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা
সরকার এখন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে, যাতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার পরিবর্তে নতুন ধরনের নিরাপদ অটো রিকশা চালু করা যাবে। নতুন নকশার অটোরিকশা চালকদের লাইসেন্স প্রদান এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দুর্ঘটনা কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই উদ্যোগও এক্ষেত্রে খুব বেশি কার্যকর হবে না, কারণ ঢাকার রাস্তা এবং সড়ক ব্যবস্থার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ।
বুয়েটের অধ্যাপক এম শামসুল হক মন্তব্য করেছেন, ঢাকার রাস্তার পরিমাণ খুবই কম এবং সেগুলোর গুণগত মানও নিম্নমানের, যেখানে সাধারণ যানবাহন চলতে পারে না। তার মতে, এই অবস্থায় অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে আনা এবং নতুন রিকশা চালু করার পরিকল্পনা অবাস্তব।
সমাধান কী?
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সমাধান হতে পারে গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি। ঢাকায় বাসরুট ফ্রেঞ্চাইজ নিয়ে সরকারের অকার্যকর সিদ্ধান্তের কারণে গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি হয়নি। বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন, যদি সরকার ছোট গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে বাস ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে, তবে সড়ক দুর্ঘটনার হার কমানো সম্ভব হতে পারে।
তবে, বর্তমান পরিস্থিতি দেখে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ধরনের সিদ্ধান্তগুলি সড়ক ব্যবস্থার সমস্যা আরও বৃদ্ধি করবে। সরকার যদি গণপরিবহন ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব দেয় না, তবে সড়ক দুর্ঘটনার হার নিয়ন্ত্রণে আনা একরকম অসম্ভব হয়ে পড়বে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ