ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে এক নতুন সংকটে ঠেলে দিয়েছে। একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্রতা এখন বিদ্বেষে পরিণত হতে চলেছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক কূটনীতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই শুরু হওয়া কূটনৈতিক উত্তেজনা এখন সরাসরি বাণিজ্য ও জনসম্পৃক্ততার ওপর আঘাত হানছে, যার প্রভাব শুধু বাংলাদেশ-ভারত নয়—পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
আন্তঃদেশীয় সম্পর্কের অবনতির সূচনা: হাসিনার পদত্যাগ ও আশ্রয়
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতা হারায় এবং তিনি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। সেই থেকে দিল্লি ও ঢাকা একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখছে। হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ, অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অভিযোগে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাঁকে দেশে প্রত্যর্পণের দাবি জানিয়ে আসছে, যদিও ভারত সরকার এখনো এই বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি।
এ প্রসঙ্গে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শ্যাম শরণ বলেন, ‘আমরা জানি, শেখ হাসিনাকে তুলে দিলে তার কী পরিণতি হতে পারে। ভারতীয় জনমতও সেটিকে সমর্থন করবে না।’
বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার সূচনা: সুতা, ট্রান্সশিপমেন্ট ও অর্থনীতির ধাক্কা
সম্প্রতি বাংলাদেশ ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ করে দেয়। এর জবাবে ভারত বাংলাদেশকে দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে। এই সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ তার তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্য ভারতের স্থল ও বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পাঠাতে পারত। ভারত ‘বন্দরে জট তৈরি হচ্ছে’ এমন অজুহাত দেখালেও অনেক বিশ্লেষকের মতে, এটি রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ারই অংশ।
এমজিএইচ গ্রুপের প্রধান আনিস আহমেদ বলেন, ‘ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট রুট ব্যবহার করে আমাদের পোশাক ইউরোপ-আমেরিকায় এক সপ্তাহে পৌঁছাত। এখন সমুদ্রপথে আট সপ্তাহ লাগবে। এটি বড় ধাক্কা।’
২০২৪ সালে ভারত বাংলাদেশে ১.৬ বিলিয়ন ডলারের সুতা রপ্তানি করে, যার এক-তৃতীয়াংশই এসেছিল স্থলপথে। এখন সেই পথ বন্ধ হওয়ায় সময় ও খরচ দুটোই বেড়ে গেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও চীনের প্রভাব
বর্তমান সরকারপ্রধান নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি চীন সফরে গিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বাংলাদেশ হয়ে ‘চীনা অর্থনীতির সম্প্রসারণের অংশ’ বলে মন্তব্য করেন এবং বাংলাদেশকে ‘সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক’ হিসেবে উল্লেখ করেন। ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই বক্তব্যের মাধ্যমে ভারতের কৌশলগত দুর্বলতা তুলে ধরা হয়েছে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে মাত্র ২০ কিলোমিটার প্রশস্ত শিলিগুড়ি করিডোর (চিকেনস নেক) দিয়ে যুক্ত। ভবিষ্যৎ সংঘাতের ক্ষেত্রে এটি একটি কৌশলগত ঝুঁকি। তাই বাংলাদেশের চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল সংক্রান্ত মন্তব্য দিল্লিকে চরম অস্থির করে তুলেছে।
বাংলাদেশি বিশ্লেষকেরা অবশ্য বলছেন, ইউনূসের বক্তব্য ‘আঞ্চলিক যোগাযোগ ও সমন্বয়’ বৃদ্ধির আহ্বান হিসেবেই বোঝা উচিত। ঢাকার তিস্তা নদী প্রকল্পে চীনের আগ্রহকেও তাঁরা ‘উন্নয়ন সহযোগিতা’ হিসেবে দেখছেন।
পোশাক খাতে প্রভাব: উভয়ের জন্যই ক্ষতির সমীকরণ
বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। গত বছর ৩৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যার ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য ভারতের স্থল ও আকাশপথ ব্যবহার করে পাঠানো হয়েছিল। সেই পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সময়, খরচ এবং বাজার পৌঁছানোর গতির ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
অন্যদিকে, ভারতের পোশাক প্রস্তুতকারকেরা বাংলাদেশ থেকে স্বল্পমূল্যের কাপড় ও সুতা আমদানি করে নিজেদের উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে রাখতেন। এখন তা বন্ধ হলে তারা বিকল্প উৎসের খোঁজে হিমশিম খাবেন, যার ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে পারে।
ভারতের পোশাক প্রস্তুতকারকদের সংগঠনও বাংলাদেশের আমদানির ওপর স্থলপথে নিষেধাজ্ঞার দাবি জানিয়েছে। এতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব ও জনমত পরিবর্তন
হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব প্রবলভাবে বাড়ছে। দিল্লির ভূমিকা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আগের সরকার যে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর জন্য দিয়েছে, সেটি পুনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে।’
বাংলাদেশে বহু বছর ধরে ভারতে যাতায়াতকারী মানুষের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখের কাছাকাছি ছিল। হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারত ভিসা প্রদানে কঠোরতা শুরু করে, ফলে ভিসা ইস্যুর হার ৮০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। এতে ব্যবসা, শিক্ষা ও চিকিৎসা খাত বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
পাকিস্তান সংযোগ ও দক্ষিণ এশীয় রাজনীতির পুনর্গঠন
এই টানাপোড়েনের মধ্যেই বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কেও একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। ১৫ বছর পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিবের ঢাকা সফর, এবং দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রীর সফরসূচি থাকা সত্ত্বেও তা স্থগিত হওয়া প্রমাণ করে যে বাংলাদেশ এখন নতুন পররাষ্ট্রনীতির সন্ধানে রয়েছে।
ভারতীয় কূটনীতিক শ্যাম শরণ বলেন, ‘বাংলাদেশ ও পাকিস্তান মিলে যদি ভারতের জন্য সমস্যা তৈরি করতে চায়, তাহলে সেটি অবশ্যই উদ্বেগের বিষয় হবে।’
সংখ্যালঘু ইস্যু, মিডিয়া ও বিভ্রান্তি
ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের খবর নিয়ে অতিরঞ্জনের অভিযোগ তুলেছেন অনেকেই। বাংলাদেশ সরকার বরাবরই বলেছে, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনাগুলোর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা অপরাধচক্র জড়িত ছিল।
বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশেরও কম। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তাও রাজনৈতিক বিভাজনকে আরও জটিল করে তুলছে।
আত্মঘাতী পথে পা ফেলছে দুই দেশ?
বিশেষজ্ঞদের মতে, উভয় পক্ষই যদি এই উত্তেজনাকে শান্তভাবে মোকাবিলা করতে না পারে, তাহলে এই বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞাগুলো ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক দুর্দশা ডেকে আনবে। দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক সমন্বয় ও পারস্পরিক সুবিধার যে সম্ভাবনা ছিল, তা এখন হুমকির মুখে।
এই প্রসঙ্গে ভারতের প্রভাবশালী থিঙ্কট্যাঙ্কের এক বিশ্লেষক মন্তব্য করেন, ‘একটি বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত কখনো কূটনৈতিক প্রতিশোধের হাতিয়ার হতে পারে না। এতে জনগণ, শিল্প ও আঞ্চলিক শান্তিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
অন্যদিকে বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, এখন সময় এসেছে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে আঞ্চলিক বাণিজ্যনীতিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



