
ছবি: সংগৃহীত
চলতি অর্থবছরের (২০২৩–২৪) প্রথম নয় মাসে বাংলাদেশে বিদেশি ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি এবং প্রকৃত অর্থছাড় আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আগের বছরের তুলনায় বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ এবং অনুদানের প্রতিশ্রুতি কমেছে ৩৪ শতাংশ। এতে দেশের চলমান ও প্রস্তাবিত সংস্কার কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটার শঙ্কা প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি যেখানে রফতানি আয় ও প্রবাসী আয়ের মাধ্যমে কিছুটা ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে, সেখানে বৈদেশিক সহায়তা হঠাৎ কমে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকির ইঙ্গিত। এই পরিস্থিতিতে উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে কাঙ্ক্ষিত কাঠামোগত সংস্কার কার্যক্রমও স্থবির হয়ে পড়তে পারে।
ইআরডি-এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই ২০২৩–মার্চ ২০২৪) বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান মিলিয়ে মোট ৪৮০ কোটি ৮৮ লাখ মার্কিন ডলার অর্থছাড় পেয়েছে। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়কালে এই অর্থছাড় ছিল ৫৬১ কোটি ৯১ লাখ ডলার, অর্থাৎ অর্থছাড় কমেছে প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ।
বিশ্লেষণে উঠে আসে, বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি কমেছে সবচেয়ে বেশি। গেল অর্থবছরের তুলনায় এ বছর মার্চ পর্যন্ত প্রথম নয় মাসে ঋণের প্রতিশ্রুতি কমে গেছে ৬০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ঋণ প্রতিশ্রুতি এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (আইডিএ) কর্মসূচি থেকে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রতিশ্রুতি এসেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে।
অন্যদিকে, চলতি অর্থবছরে অনুদানের প্রতিশ্রুতিও অনেক কমেছে। গত বছরের প্রথম নয় মাসে অনুদান হিসেবে প্রতিশ্রুতি ছিল ৫০ কোটি ২১ লাখ ডলার, এবার তা এসে দাঁড়িয়েছে ৩৩ কোটি ৫৯ লাখ ডলারে—যা প্রায় ৩৪ শতাংশ কম।
অর্থছাড় ও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি যেখানে নিম্নমুখী, সেখানেই উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২১.৪৬ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, ঋণ পরিশোধে ব্যয় বাড়া স্বাভাবিক, তবে নতুন ঋণের প্রবাহ কমে যাওয়ায় এটিই ভবিষ্যতে অর্থনীতির জন্য চাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবির বলেন, এই পরিস্থিতি কেবল বৈদেশিক সাহায্যের সংকট নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক রূপান্তরের পথে একটি বড় বাধা হতে পারে। তাঁর ভাষায়,
"আইএমএফের ঋণ ছাড় এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি। অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকেও আশানুরূপ প্রতিশ্রুতি বা অর্থছাড় মিলছে না। এই বাস্তবতায় কাঠামোগত সংস্কারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ থমকে যেতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। একবার এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তীর্ণ হলে বিদেশি অনুদান ও সহজ শর্তের ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। এ জন্য এখন থেকেই সরকারকে খুবই সচেতন হতে হবে। “এ পরিস্থিতিকে আগাম সতর্ক সংকেত ধরে নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পে অগ্রাধিকার ঠিক করা এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থায়নের কৌশল নির্ধারণ করতে হবে,”—বলেছেন ড. মাহফুজ।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, স্বচ্ছতা, দুর্নীতির অভিযোগ, প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে উন্নয়ন সহযোগীরা আরও সংযত হয়েছে। বিদেশি সাহায্যের শর্তও দিন দিন কঠিন হচ্ছে, বিশেষ করে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও জাইকার মতো সংস্থাগুলো তাদের সহায়তার বিনিময়ে সংস্কার বাস্তবায়নের অগ্রগতি দেখতে চায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারকে এখনই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে উন্নয়ন সহযোগীদের আস্থা ফিরে আসে। একইসঙ্গে, উচ্চাভিলাষী ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যয়ের প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করে অগ্রাধিকারভিত্তিক খাতে বিনিয়োগ করতে হবে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন, বৈদেশিক সহায়তা কমে যাওয়ার এ সংকেতকে হালকাভাবে না নিয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিক পরিকল্পনা নিতে হবে। তারা বলছেন, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে নিজস্ব রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রকল্পের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় কঠোরতা আনতে হবে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও অত্যাবশ্যক।
অন্যথায়, বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর গতি কমে গিয়ে দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হুমকিতে পড়তে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ