
ছবি: সংগৃহীত
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘আরাকান আর্মি’ বা এএ-এর সঙ্গে সংঘর্ষ যত তীব্র হচ্ছে, ততই সাধারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী জীবন বাঁচাতে বাধ্য হচ্ছে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা এখন কার্যত এক মানবিক সংকট ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ৬ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে—অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ২২০ জন। গত দেড় বছরে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করা হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার নতুন অনুপ্রবেশকারীর।
রাখাইনের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে জান্তা বাহিনীর ক্রমবর্ধমান হামলার শিকার হয়ে পড়ছে সাধারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে টানা সংঘর্ষে জান্তা সরকার সশস্ত্র উপস্থিতি জোরালো করেছে, আর এই সংঘাতে বাড়ছে নাগরিক হতাহত ও বাস্তুচ্যুতির ঘটনা। ফলে বহু রোহিঙ্গা, যারা ইতিপূর্বে নিজেদের জন্মভূমিতে কোনোমতে টিকে থাকার চেষ্টা করছিল, এখন বেছে নিচ্ছে বিপদসংকুল সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পথ।
জাতিসংঘ সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক করিডর খোলার আহ্বান জানিয়েছে, যাতে যুদ্ধবিধ্বস্ত রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা নিরীহ জনগণকে বাংলাদেশে খাদ্য সহায়তা ও আশ্রয় দেওয়া যায়। কিন্তু এ প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে গভীর উদ্বেগ, সন্দেহ এবং জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে শঙ্কা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম এই প্রস্তাবকে সরাসরি বাংলাদেশের কৌশলগত নিরাপত্তার জন্য ‘গভীর হুমকি’ হিসেবে আখ্যা দেন। তার মতে, এই করিডর চালু হলে বিষয়টি শুধু মানবিক সংকট হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকবে না—বরং তা জাতীয় নিরাপত্তা, সীমান্ত শৃঙ্খলা ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার বড় বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “এতদিন পর হঠাৎ কেন জাতিসংঘ এই করিডরের কথা বলছে? এর পেছনে কোন ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য লুকানো আছে কি না, তা যাচাই না করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হবে না।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “জাতিসংঘের প্রস্তাবের পূর্ণাঙ্গ খসড়া, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কৌশল জনসমক্ষে প্রকাশ করা দরকার। দেশের মানুষকে অন্ধকারে রেখে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া আত্মঘাতী হবে।”
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনিরুজ্জামানও করিডরের বিরোধিতা করে বলেন, “রাখাইন একটি স্পর্শকাতর এলাকা, সেখানে শুধু মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পক্ষগুলো নয়, চীন, ভারত, রাশিয়া, আমেরিকার মতো পরাশক্তিগুলোর ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। করিডর চালু হলে এসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের জটিল সম্পর্কের উদ্ভব হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “একটি অস্থায়ী সরকার বা সংসদহীন রাজনৈতিক বাস্তবতায় এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ছাড়া করিডর চালু হলে তা জাতীয় স্বার্থে আত্মঘাতী পদক্ষেপে রূপ নিতে পারে।”
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মে মাসের শুরু পর্যন্ত বাংলাদেশে নতুন করে ১ লাখ ১৫ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে, যাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া আরও ৫ থেকে ১০ হাজার রোহিঙ্গা এখনো অনিবন্ধিত অবস্থায় সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান করছে বলে জানা গেছে।
তিনি বলেন, “২০২৪ সালের মে, জুন ও জুলাই মাসে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ওই সময় মংডু এলাকায় জান্তা বাহিনীর হামলা বেড়ে যায়, আর সীমান্তে বিজিবির নজরদারি কমে গিয়েছিল।”
বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ৫১ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ২৭টি কক্সবাজার ক্যাম্পে অধিকাংশ রোহিঙ্গা পুরোনো শরণার্থীদের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে আশ্রয়ে রয়েছে।
আরআরআরসি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ৯০টি রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হচ্ছে। প্রতিবছর জন্ম হচ্ছে ৩০ হাজার শিশু, যা ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আরও বড় আকারে বিস্তৃত করে তুলছে। বর্তমানে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৫২% শিশু, ৪৪% প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৪% প্রবীণ। নারী-পুরুষের অনুপাতও প্রায় সমান—নারী ৫১% এবং পুরুষ ৪৯%।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধে সীমান্তে দায়িত্বরত বিজিবির নানামুখী সীমাবদ্ধতা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কক্সবাজার রিজিয়নের বিজিবি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এমএম ইমরুল হাসান বাস্তবতা তুলে ধরে বলেন, “রাতের আঁধারে দালালদের সহায়তায় রোহিঙ্গারা সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়ছে। বিজিবির সদস্যরা কোমরসমান কাদামাটি ও পানির ভেতর দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দৌঁড়াতে হয়। একদিকে ছুটে গেলে অন্যদিক দিয়ে তারা ঢুকে পড়ে।”
তিনি বলেন, “অনুপ্রবেশ ঠেকাতে গিয়ে আমাদের সদস্যরা মাঝে মাঝে হামলার শিকার হন। কিন্তু মানুষকে গুলি করে মারা তো সম্ভব নয়। মানবাধিকার বলে একটা বিষয় আছে, যা আমরা শ্রদ্ধা করি।”
বর্তমানে সীমান্তে নেই পর্যাপ্ত আলো, আধুনিক ক্যামেরা কিংবা মনিটরিং প্রযুক্তি। কাঁটাতারের কোনো ব্যারিকেডও নেই। বিজিবি এসব ঘাটতির কথা উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আরও দুটি ব্যাটালিয়ন চেয়ে প্রস্তাব দিয়েছে।
ব্রিগেডিয়ার ইমরুল বলেন, “এ মুহূর্তে বিজিবি একা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারবে না। স্থানীয় জনগণকে এগিয়ে এসে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দিয়ে সহযোগিতা করতে হবে।”
তিনি স্পষ্ট বলেন, “রোহিঙ্গারা জানে, তারা বাংলাদেশে ঢুকলে আশ্রয় পাবে। সেই ভরসাতেই তারা সাহস পায়। যদি তারা জানত আশ্রয় মিলবে না, তাহলে এত সহজে ঢুকত না।”
বাংলাদেশ বর্তমানে এক গভীর মানবিক ও কৌশলগত সংকটের মুখোমুখি। একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহানুভূতি, অন্যদিকে সীমান্ত নিরাপত্তা, জাতীয় স্বার্থ ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার প্রশ্ন। এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই জাতিসংঘের প্রস্তাবিত ‘মানবিক করিডর’ ব্যবস্থা অনেকের কাছেই এক নতুন আন্তর্জাতিক চাপ ও ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত বলেই মনে হচ্ছে। সরকারের উচিত হবে—রাজনৈতিক দল, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাধারণ জনগণের সঙ্গে পরামর্শ করে সুসংহত ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ