
ছবি: সংগৃহীত
দেশের অর্থনৈতিক সূচকে সামান্য কিছু ইতিবাচক দিক যেমন রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় বেড়েছে, কিন্তু বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে বৈদেশিক ঋণপ্রবাহের ক্ষেত্রে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পাওয়া ঋণ প্রতিশ্রুতি কমেছে ৫৮ শতাংশেরও বেশি। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা এটিকে উদ্বেগজনক হিসেবে দেখছেন। এর বিপরীতে আগের সরকারের নেওয়া ব্যাপক ঋণের বোঝা নতুন সরকারের কাঁধে এসে পড়েছে, যার পরিণতিতে ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত।
ঋণ প্রতিশ্রুতিতে বড় ধস
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) গতকাল বুধবার যে মাসিক হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই ২০২৪ - মার্চ ২০২৫) বাংলাদেশকে দেওয়া বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি এসেছে মাত্র ৩০০ কোটি ৫২ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ পরিমাণ ছিল ৭২৪ কোটি ডলার। এক বছরের ব্যবধানে এই প্রবাহ কমেছে প্রায় ৫৮.৫ শতাংশ।
এ ধরনের পতনকে ইআরডি ও নীতিনির্ধারকরা দেখছেন একটি নীতিগত পরিবর্তনের অংশ হিসেবে। অর্থাৎ নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আগের সরকারের মতো ঋণনির্ভর প্রকল্পে না ঝুঁকে যাচাই-বাছাই করে প্রকল্প গ্রহণ করছে। এ কারণে অনেক প্রকল্পের ক্ষেত্রে এখনো ঋণচুক্তি হয়নি বা দেরিতে হচ্ছে।
প্রধান ঋণদাতা সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণ
এ সময়ে সবচেয়ে বড় ঋণ প্রতিশ্রুতি এসেছে বিশ্বব্যাংকের আইডিএ কর্মসূচি থেকে, যার পরিমাণ ৯৪ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। এরপর আছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), যারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ৭০ কোটি ডলার। তবে সামগ্রিক চিত্রে দেখা যাচ্ছে, অন্যান্য সহযোগী সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণ কমেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নয়ন সহযোগীরা এখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে নজর দিচ্ছে। দীর্ঘদিনের একক দলের শাসন শেষে সরকার পরিবর্তনের ফলে নীতিনির্ধারণের গতি শ্লথ হয়েছে, যা উন্নয়ন সহযোগীদের দৃষ্টিতে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। ফলে তারা অপেক্ষাকৃত সংযত অবস্থানে আছে।
অর্থছাড় ও পরিশোধে বৈষম্য
ঋণ প্রতিশ্রুতি কমার পাশাপাশি প্রকল্পে অর্থছাড়ের পরিমাণও হ্রাস পেয়েছে। মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থছাড় হয়েছে ৪৮০ কোটি ৮৮ লাখ ডলার, যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে অর্থছাড় হয়েছিল ৫৬৩ কোটি ১৬ লাখ ডলার। অর্থাৎ অর্থছাড় কমেছে ১৪.৬১ শতাংশ।
অন্যদিকে ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। এ সময় বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হয়েছে ৩২১ কোটি ২০ লাখ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৮ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা)। আগের অর্থবছরের তুলনায় এটি ২৫ শতাংশ বেশি। গত বছরের একই সময়ে পরিশোধের পরিমাণ ছিল ২৫৭ কোটি ডলার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঋণ মূলত আগের সরকারের সময় নেওয়া প্রকল্প ঋণের কিস্তি। এসব ঋণ ছিল বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প, মেগা প্রকল্প ও কখনো কখনো অপ্রয়োজনীয় খাতেও বরাদ্দ দেওয়া।
সরকারের বাজেট সহায়তার আশাভরসা
বর্তমান সরকার চলতি অর্থবছরে মোট ১০ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের কাছ থেকে ২২০ কোটি ডলার, বিশ্বব্যাংক থেকে ২৪৫ কোটি এবং এডিবি থেকে ১৭৯ কোটি ডলারের সহায়তা পাওয়ার আশাবাদ রয়েছে। তবে এখনো তা নিশ্চিত নয়।
এ ছাড়া সরকারের হাতে থাকা পাইপলাইনে আরও প্রায় ৯০০ কোটি ডলারের প্রকল্প ঋণ রয়েছে। যার মধ্যে এডিবির রয়েছে ২৭৫ কোটি ৬৩ লাখ ডলার, বিশ্বব্যাংকের রয়েছে ২০৮ কোটি এবং আমেরিকা-জাপানের যৌথ প্রকল্পে রয়েছে ২০৪ কোটি ডলারের ঋণ সম্ভাবনা।
অর্থনীতিবিদদের মতামত
বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ আহমেদ বলেন, “বর্তমানে বৈদেশিক ঋণ প্রবাহে যে সংকোচন দেখা যাচ্ছে, তা মূলত দেশের নীতিগত পুনর্বিন্যাসের ফল। তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি ইতিবাচক হতে পারে, কারণ এর ফলে প্রকল্প অনুমোদনে আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে।”
অন্যদিকে পরিকল্পনা বিশ্লেষক ও সাবেক সচিব হাফিজুর রহমান বলেন, “যদি ঋণ প্রতিশ্রুতি না বাড়ে, তবে আগামী বাজেট বাস্তবায়নে তহবিল ঘাটতি তৈরি হবে। সরকারকে দ্রুত কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে উন্নয়ন সহযোগীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে।”
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ
অনেকেই বলছেন, গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভর করে প্রকল্প নিয়েছে, তার চাপ এখন নতুন সরকারের ঘাড়ে এসে পড়েছে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে হলে একদিকে যেমন নতুন প্রকল্প গ্রহণে সংযম দরকার, অন্যদিকে বিদ্যমান প্রকল্পগুলো দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করাও জরুরি।
ইআরডি সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, “আগে অনেক প্রকল্প একসঙ্গে নেওয়া হয়েছিল, যেগুলোর বাস্তবায়ন ও অর্থছাড়ে সমস্যা হয়েছে। এখন আমরা গুণগত মান নিশ্চিত করে ধীরে এগোচ্ছি। তবে আগামী মাসগুলোতে ঋণ প্রতিশ্রুতি বাড়বে বলেই আশা করছি।”
বিদেশি ঋণ প্রতিশ্রুতি কমার এই ধারা যদি দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকে, তবে তা সরকারের বাজেট বাস্তবায়ন এবং অবকাঠামো উন্নয়নে বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষ করে যখন বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা এখনও অনেক বেশি। সুতরাং, কূটনৈতিক উদ্যোগ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের দক্ষতা—এই তিনটি কৌশলের সমন্বয়ই পারে বাংলাদেশের বৈদেশিক অর্থায়নের গতি ফিরিয়ে আনতে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ