
ছবি: সংগৃহীত
রাজনীতির উত্তাল মঞ্চে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করতে যাচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। আওয়ামী লীগের দলীয় বিচার, নিবন্ধন বাতিল এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবিতে আগামী শুক্রবার (২ মে) রাজধানী ঢাকার জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকে একটি বৃহৎ জনসমাবেশ আয়োজন করতে যাচ্ছে দলটি। দীর্ঘদিন ধরে ছোট ছোট বিক্ষোভ সমাবেশের পর এবার একটি প্রভাবশালী ও বৃহৎ জমায়েতের মধ্য দিয়ে তারা তাদের অবস্থানকে দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করতে চায়।
এনসিপির ঢাকা মহানগর শাখার আয়োজনে অনুষ্ঠিতব্য এ সমাবেশে উপস্থিত থাকবেন দলের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ, কেন্দ্রীয় নেতা সারজিস আলম, আরিফুল ইসলাম আদীব, জয়নাল আবেদীন শিশিরসহ অন্যান্য শীর্ষ নেতারা। ইতোমধ্যেই ঢাকার গুলিস্তান, বাংলামটর, মিরপুর, গুলশান, মোহাম্মদপুর ও ফার্মগেটসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এনসিপির নেতাকর্মীরা লিফলেট বিতরণ, গণসংযোগ ও পোস্টারিং কার্যক্রম চালাচ্ছেন।
এনসিপি তাদের লিফলেটে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে সংগঠিত সাতটি ‘গুরুতর অপরাধ’ উল্লেখ করে বলেছে, এসব অপরাধের বিচার না হওয়ায় দেশে ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র চরমভাবে বিপন্ন হয়েছে। অভিযোগগুলো হলো:
২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তার ‘হত্যাকাণ্ড’, যা সরকার দক্ষতার সঙ্গে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছিল বলে দাবি করা হয়।
গুম, খুন ও ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের জীবনহানি, যা বিরোধী কণ্ঠ রোধে ব্যবহৃত হয়েছে।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি 'অবৈধ' নির্বাচন, যার মাধ্যমে ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে।
২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের হেফাজত সমাবেশে চালানো ‘হত্যাকাণ্ড’।
লাখ কোটি টাকা দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থপাচার, যেগুলো দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করেছে।
২০২১ সালে মোদিবিরোধী আন্দোলনে সরকারি দমননীতি ও হত্যাকাণ্ড।
২০২4 সালের জুলাইয়ে তথাকথিত 'গণঅভ্যুত্থান' চলাকালে হত্যাকাণ্ড, যাকে দলটি ‘গণহত্যা’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
এনসিপির বিতরণ করা লিফলেটে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চারটি মৌলিক দাবির কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে:
আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ট্রাইব্যুনাল বা কমিশনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচার।
আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করা।
বিচার চলাকালে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাখা।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার ও তাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “আওয়ামী লীগ ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে। তারা ২০১৩ সালে হেফাজতের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানুষ রায় দিয়েছে, কিন্তু তাদের বিচার হয়নি। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবার আমাদের লড়াই আরও শক্ত হবে।”
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, “এই কর্মসূচি থেকে আমরা একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে চাই—গণহত্যার দায়ে ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার চাই। একই সঙ্গে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম ও নিবন্ধন বাতিলের দাবি তুলব।”
এনসিপির ঢাকা দক্ষিণের সংগঠক আসাদ বিন রনি বলেন, “ঢাকায় আমাদের ২০-৩০ হাজার সক্রিয় সমর্থক রয়েছে। তারা সবাই এই কর্মসূচিতে থাকবে। এছাড়া কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ও শুভাকাঙ্ক্ষীরাও অংশ নেবেন।”
দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব জয়নাল আবেদীন শিশির বলেন, “আমরা বিগত কয়েক বছর ধরে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন করছি। এবার একটি সর্ববৃহৎ সমাবেশের মাধ্যমে জনগণের দাবিকে রাষ্ট্রের কর্ণধারদের কানে পৌঁছে দিতে চাই।”
দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “জুলাইয়ের গণরায়ে জনগণ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এরপরও তারা রাজনীতি করছে—এটা আমরা মেনে নিতে পারি না। আওয়ামী লীগ যেন আর কোনোভাবেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে না পারে, এনসিপি সে বিষয়ে সবসময় সজাগ থাকবে।”
পূর্ববর্তী সমাবেশগুলোতে কম জনসমাগম হওয়ায় এনসিপি সমালোচনার মুখে পড়ে। গুলশান, ফার্মগেট, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে কয়েকটি খণ্ড সমাবেশে নেতাকর্মী ও উপস্থিত জনতার সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এনসিপির নেতারা এবার তা থেকে শিক্ষা নিয়েই বৃহৎ উপস্থিতির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
গত ২৬ এপ্রিল এনসিপির এক অভ্যন্তরীণ সভায় আগামী সমাবেশে ‘রেকর্ড সংখ্যক উপস্থিতি’ নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির এই উদ্যোগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করছে। একটি তুলনামূলকভাবে নবীন ও ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল হয়েও এ ধরনের স্পষ্ট ও কট্টর অবস্থান নেওয়া নজিরবিহীন। যদিও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবি সাংবিধানিক ও রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর, তথাপি এনসিপির পদক্ষেপটি দেশের চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যেই এক ধরণের প্রতিবাদী শক্তির উত্থান হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ