
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে যদি একটি বিশাল দেহ হিসেবে কল্পনা করি, তবে তার মেরুদণ্ড নিঃসন্দেহে কৃষি, গার্মেন্টস শিল্প এবং প্রবাসী আয়—এই তিন খাত। আর এই তিন খাতের প্রাণভোমরা হচ্ছে শ্রমিকরা। তারা অক্লান্ত পরিশ্রম, ঘাম ও কষ্টের বিনিময়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছেন। কিন্তু যে শ্রমিকদের ঘামে সমৃদ্ধ হচ্ছে জিডিপি, বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং বিস্তৃত হচ্ছে রপ্তানি বাজার—তাদের অবস্থা দিন দিন করুণ থেকে করুণতর হচ্ছে। অর্থনীতি যতোই এগিয়ে যাক, শ্রমিকের জীবনে যেন সেই অগ্রগতির ছোঁয়া লাগে না।
দেশে বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যেটা প্রচার করা হয় তা হলো 'সস্তা শ্রম'। এই ‘সস্তা’ শব্দটি যেন আজ একটি অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রমিকদের জন্য। বিনিয়োগকারীরা যেমন কম খরচে উৎপাদনে লাভবান হন, তেমনই রাষ্ট্রও গর্ব করে এই মডেল নিয়ে। অথচ সেই মডেলের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা শ্রমিকের ঘরে নেই নিরাপত্তা, নেই পর্যাপ্ত খাদ্য, নেই ন্যায্য মজুরি। একদিকে গর্ব করা হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে, অন্যদিকে এই উন্নয়নের সবচেয়ে বড় কারিগরেরাই থাকছেন অবহেলার চোরাবালিতে।
বাংলাদেশের কৃষি খাত এখনো জীবন্ত। রপ্তানির প্রধান খাত গার্মেন্টস। বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স। এই তিন খাতই শ্রমনির্ভর। অথচ শ্রমিকদের নিয়েই জাতীয় পর্যায়ে নেই কোন সর্বজনীন সুরক্ষা। জানা গেছে, কৃষি, গার্মেন্টস এবং প্রবাসী শ্রমিক—এই তিন খাতেই শ্রমিকরা উচ্চ ঝুঁকিতে কাজ করলেও, তারা সর্বনিম্ন মজুরি ও নিরাপত্তা সুবিধা থেকেও বঞ্চিত।
প্রতি বছর মে দিবসে শ্রমিকদের নিয়ে ঘটা করে আলোচনা হয়, অনুষ্ঠান হয়, নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু বাকি ৩৬৪ দিন এই মানুষগুলো যেন রাষ্ট্র ও সমাজের নজর থেকে হারিয়ে যান। অথচ এই শ্রমিকরাই প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে দেশের অর্থনীতিকে গতিময় রাখেন।
স্বাধীনতার এত বছর পরেও দেশে কোনো জাতীয় মজুরি কমিশন গঠিত হয়নি। ফলে অধিকাংশ খাতে এখনো নেই নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি। শ্রমিকরা যা আয় করেন, তা দিয়ে চলতে গিয়ে তাদের হিমশিম খেতে হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ১৪২টি খাত-উপখাতের মধ্যে ৮৪টিতে ন্যূনতম মজুরি নেই। এ ছাড়া জীবিকা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে পণ্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে।
প্রবাসী শ্রমিকদেরও অবস্থা শোচনীয়। করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিদেশে শ্রমবাজার সংকুচিত হয়েছে। অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন, নতুন করে কাজ পাচ্ছেন না, আবার পাঠানো রেমিট্যান্সেও ধীরগতি দেখা দিয়েছে।
সরকার বলছে দেশে বেকারের সংখ্যা মাত্র ২৬ লাখ ৩০ হাজার। কিন্তু বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। সিপিডি এবং আইএলও-র তথ্যমতে, দেশে প্রকৃত অর্থে সাড়ে ৪ কোটির বেশি মানুষ বেকার বা কর্মসংস্থানবিহীন। কারণ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী সপ্তাহে ১ ঘণ্টা কাজ না পেলে তাকেই বেকার হিসেবে ধরা হয়। আর সেই হিসাবে বিশাল জনগোষ্ঠী কর্মহীন।
২০০৬ সালের শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিক সেই ব্যক্তি, যিনি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কাজের বিনিময়ে মজুরি পান। এতে যেমন কায়িক শ্রমিক, তেমনি কারিগরি ও অফিস সহকারী শ্রেণিও পড়ে। তবে বাস্তবে দেখা যায়, অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কোনো অধিকারই প্রতিষ্ঠিত নয়। রিকশাচালক, নির্মাণ শ্রমিক, হকার, কৃষিকর্মী, এমনকি গৃহকর্মীরাও পড়ে যান ‘আইনের বাইরের’ অঞ্চলে।
সিপিডির তথ্যমতে, দেশের ৮৫ শতাংশ শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। তাদের জন্য নেই কোনো সুনির্দিষ্ট ন্যূনতম মজুরি, নেই সামাজিক সুরক্ষা। এর বিপরীতে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন মাত্র ১৩ শতাংশ শ্রমিক। তারা তুলনামূলক ভালো থাকলেও, এখানেও নির্যাতন, দুর্ঘটনা এবং ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার ঘটনা অহরহ।
শ্রম সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের গিনি সহগ বিশ্লেষণ অনুযায়ী সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষের হাতে মোট জাতীয় আয়ের ৪৪ শতাংশ। শীর্ষ ১ শতাংশ আয় করেন ১৬.৩ শতাংশ। অন্যদিকে দেশের ৫০ শতাংশ গরিব মানুষের আয় মাত্র ১৭.১ শতাংশ। এ বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক অস্থিরতাও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র চারটি দাবি সামনে এনেছে:
শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন
ন্যূনতম মজুরি ৩০ হাজার টাকা নির্ধারণ
আইএলও কনভেনশন অনুসারে শ্রম আইনের সংস্কার
সর্বজনীন রেশনের ব্যবস্থা
শ্রম সংস্কার কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে কর্মক্ষেত্রে ৮ হাজার ২৯৮ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। ২০২৪ সালেই ৮২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৬১৭ জন। অথচ ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন হাতে গোনা কয়েকজন। এসব ঘটনা শ্রমিক নিরাপত্তার ভয়াবহ ঘাটতির প্রতিচ্ছবি।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০২৫ সালের মধ্যে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১ কোটি ৫৮ লাখে। ২০২৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২৮ লাখ। অর্থাৎ আরও ৩০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে। কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে প্রকৃত আয় কমে যাওয়া, শ্রমবাজারে দুর্বলতা এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতা।
ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের গেজেট অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন খাতে মজুরি ব্যবধানে বিস্ময়কর ফারাক। কোথাও মাসিক মজুরি মাত্র ২ হাজার টাকা, আবার কোথাও তা ১৬ হাজারের বেশি। গার্মেন্টস খাতেও সর্বনিম্ন মজুরি মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকা। অথচ এ খাত থেকেই আসে দেশের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা।
ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এবং মোস্তফা কে মুজেরীর মতো অর্থনীতিবিদরা বলছেন—শ্রমিকদের কাজে লাগাতে হলে প্রথমেই দরকার উপযুক্ত বিনিয়োগ এবং শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার। পাশাপাশি জনশক্তিকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায় এই জনসংখ্যা আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান যাদের, তারাই আজ সবচেয়ে অবহেলিত। কেবল মে দিবসে স্মরণ নয়, বরং সারা বছর ধরে শ্রমিকদের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নইলে যে অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠেছে তা অচিরেই ভেঙে পড়তে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ