
ছবি: সংগৃহীত
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও ইতিবাচক ধারায় প্রবেশ করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর হিসাব অনুযায়ী, বুধবার (১ মে) বাংলাদেশের রিজার্ভ ২২ দশমিক শূন্য চার (22.04) বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, যা সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক চাপে থাকা বাংলাদেশের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ও আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে এই উল্লম্ফন দেখা গেছে। তিনি বলেন, “বর্তমানে আমাদের রেমিট্যান্সের গতি অত্যন্ত ইতিবাচক, মার্চ মাসে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ এসেছে প্রবাসীদের পাঠানো হিসেবে। পাশাপাশি পণ্য রপ্তানির প্রবৃদ্ধিও রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাব অনুযায়ী—যেখানে স্বর্ণ, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ), এবং অন্যান্য বিনিয়োগযোগ্য সম্পদও অন্তর্ভুক্ত করা হয়—বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। তবে আইএমএফের নির্দেশনা অনুসারে হিসাব করলে, যেখানে শুধুমাত্র ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ অন্তর্ভুক্ত থাকে (যা তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতে ব্যবহার করা যায়), সেখানে পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে দেখা হয়।
গত এক সপ্তাহেই রিজার্ভে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। আইএমএফ পদ্ধতিতে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক চার এক (21.41) বিলিয়ন ডলার, সেখান থেকে মাত্র এক সপ্তাহে তা বেড়ে ২২ বিলিয়ন ডলারের ঘর পেরিয়ে যায়। এর ফলে অর্থনীতি কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে।
রেমিট্যান্স প্রবাহের ক্ষেত্রে মার্চ মাসে বাংলাদেশ নতুন এক ইতিহাস গড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মার্চ মাসে প্রবাসীরা দেশে মোট ৩ দশমিক ২৯ (3.29) বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন—যা দেশের ইতিহাসে এক মাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রবাহ। এটি পূর্বের সকল মাসিক রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে এবং এর ধারাবাহিকতা চলমান থাকলে ভবিষ্যতে আরও রিজার্ভ বৃদ্ধির আশা করা হচ্ছে।
অপরদিকে, এপ্রিল মাসের ২৯ দিনেই এসেছে দুই দশমিক ছয় এক (2.61) বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স, যা শেষ পর্যন্ত এপ্রিলকেও একটি শক্তিশালী মাসে পরিণত করতে পারে।
রপ্তানি আয়ের দিকটিও সন্তোষজনক। পোশাক খাত থেকে শুরু করে হিমায়িত খাদ্য, চামড়া ও কৃষিপণ্যের রপ্তানি আয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ভালো প্রবৃদ্ধি এসেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের চাহিদা স্থিতিশীল রয়েছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই রিজার্ভ বৃদ্ধি স্বল্পমেয়াদে সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় স্বস্তি আনলেও দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে রপ্তানির বহুমুখীকরণ, প্রবাসী আয়ে অনিয়ম প্রতিরোধ এবং আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর আব্দুর রউফ তালুকদার এক বিবৃতিতে জানান, “আমরা রিজার্ভ পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক আছি এবং আগামী দিনে যাতে আর বাড়ে সে জন্য প্রয়াস চালাচ্ছি। বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ ছাড়, উন্নয়ন সহায়তা, ও রপ্তানি প্রণোদনার কার্যকারিতা বাড়ানো নিয়েও পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।”
অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও বাজেট বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী জুন মাসে বাজেট ঘোষণার আগে রিজার্ভ পরিস্থিতির এই ধারা সরকারকে কিছুটা কৌশলগত সুবিধা এনে দেবে, বিশেষ করে ঋণ পরিশোধ, আমদানি বিল পরিশোধ এবং নীতিগত স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে।
তবে সতর্কতার দিকটিও উঠে এসেছে। সম্প্রতি বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় আমদানি ব্যয় বাড়তে পারে, আবার বৈশ্বিক রাজনৈতিক উত্তেজনার ফলে রপ্তানিতে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। সেই কারণে, রিজার্ভ বাড়লেও সরকারের উচিত হবে আমদানি ভারসাম্য রক্ষা ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনা।
অর্থাৎ, রিজার্ভে এই ইতিবাচক মোড় বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য তাৎক্ষণিক স্বস্তি বয়ে আনলেও, তা ধরে রাখার জন্য আরও কার্যকর কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন—এমনটাই মত অর্থনীতি বিশ্লেষকদের।
বাংলাবার্তা/এমএইচ