
ছবি: সংগৃহীত
দেশের জ্বালানি খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা। সংস্থাটি জানিয়েছে, গ্যাস খাতের সব ধরনের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দেনা পরিশোধ করে তারা এখন ঋণমুক্ত অবস্থানে রয়েছে। এই অর্জন শুধু আর্থিক ভারসাম্যই রক্ষা করেনি, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্যতা ও ক্রেডিট রেটিং উন্নয়নের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পেট্রোবাংলা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সময় তাদের ওপর মোট দেনা ছিল ৭৩৭ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় আট হাজার ৭০২ কোটি টাকা। এই বিপুল ঋণ কমিয়ে আনার জন্য সংস্থাটি একটি কার্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং জুন ২০২৫ পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণ করলেও নির্ধারিত সময়ের দুই মাস আগেই তারা সমস্ত দেনা শোধ করতে সক্ষম হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, পেট্রোবাংলা এখন পর্যন্ত গ্যাস খাতে মোট ৩ হাজার ৭৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ৪৫ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। এই বিশাল অর্থের মধ্যে শুধু মূল দেনাই নয়, অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বিলম্ব সুদ বাবদ পরিশোধ করা ৫৪ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৬৫৪ কোটি টাকা)। আগে সময়মতো দেনা পরিশোধ না করায় প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়মিত বিলম্ব সুদ গুনতে হতো, যার ফলে বাজেট ও অপারেশনাল ব্যয় বাড়ছিল। কিন্তু এখন এ ধরনের বাড়তি খরচ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
দেনা পরিশোধের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পেট্রোবাংলা তাদের দায়সমূহ পরিশোধ করেছে একাধিক আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ উৎসের কাছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলনকারী আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো যেমন শেভরন ও তাল্লো, এলএনজি সরবরাহে যুক্ত কাতার এনার্জি এবং ওকিউটি (OQT), স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস সরবরাহকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল (FSRU), এবং আন্তর্জাতিক ইসলামিক ট্রেড ফিন্যান্স করপোরেশনের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
এইসব প্রতিষ্ঠানকে শুধু আট হাজার কোটি টাকার দেনা নয়, বরং অতিরিক্ত আরও ১৭ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা, অর্থাৎ এক হাজার ৪৪৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে পেট্রোবাংলা। এর ফলে এখন আর কোনো প্রতিষ্ঠান বা উৎসের কাছে মেয়াদোত্তীর্ণ বা বকেয়া পাওনা নেই, যা সরবরাহ চুক্তির ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করবে।
পেট্রোবাংলা দাবি করেছে, এই দেনা পরিশোধের ফলে আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেটে এলএনজি সরবরাহকারীদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে সরবরাহ প্রতিযোগিতা বাড়বে, কম প্রিমিয়ামে এলএনজি পাওয়া সম্ভব হবে, এবং আমদানির ব্যয় হ্রাস পাবে। একইসঙ্গে, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় যারা বাংলাদেশে গ্যাস সরবরাহ করছে, তারা এখন নির্ধারিত সময়মতো এলএনজি কার্গো লোডিং সম্পন্ন করতে আরও আগ্রহী হবে, যা সরবরাহ শৃঙ্খলা ও ঝুঁকিমুক্ত আমদানি চেইন নিশ্চিত করবে।
তবে এই পুরো অর্থ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারকেও ভূমিকা রাখতে হয়েছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং অর্থ বিভাগের অনুমোদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) পেট্রোবাংলাকে সহায়তা হিসেবে দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। এটি একটি স্বল্পমেয়াদি সহায়তা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, যাতে রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় কোনো চাপ তৈরি না হয় এবং প্রতিষ্ঠানটির চলমান কার্যক্রম ব্যাহত না হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আর্থিক পুনর্গঠন কেবল একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়মুক্ত করল না, বরং জ্বালানি খাতে সামগ্রিক স্থিতিশীলতার পথ প্রশস্ত করল। কারণ গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থায় আস্থার অভাব মানেই আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, ডলার সঙ্কট ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে বিঘ্ন। পেট্রোবাংলার এই সফলতা তাই জাতীয় অর্থনীতির জন্য একটি বড় স্বস্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তারা আরও মনে করছেন, ভবিষ্যতে গ্যাস আমদানি ও সরবরাহ ব্যবস্থাকে টেকসই করতে হলে এমন সময়মতো দেনা পরিশোধের সংস্কৃতি বজায় রাখতে হবে। সেইসঙ্গে অভ্যন্তরীণ গ্যাস উত্তোলনেও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে যাতে আমদানি নির্ভরতা কমে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ