
ছবি: সংগৃহীত
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-এর কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ‘র্যাব আইন, ২০২৪’ নামে একটি খসড়া প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাহিনীর মহাপরিচালক (ডিজি) একেএম শহীদুর রহমান। গতকাল (বুধবার) পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত এক গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এই তথ্য জানান। দীর্ঘদিন ধরেই র্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে, যার প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমালোচনার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালে র্যাব ও সংস্থাটির ছয়জন সাবেক কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরও র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করে।
সেমিনারে র্যাব ডিজি বলেন, খসড়া আইনটি কার্যকর হলে আর কেউ ব্যক্তিগত স্বার্থে আইন প্রয়োগকারী ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারবে না। তিনি জানান, বাহিনীটিকে জবাবদিহির আওতায় আনতে সম্প্রতি একটি মানবাধিকার সেল গঠন করা হয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ তদন্ত ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি তিনি দাবি করেন, র্যাব এখন মানবাধিকারের প্রতি আরও বেশি প্রতিশ্রুতিশীল এবং সংস্থাটি নিজেরাই শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে।
২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে র্যাব ৪৪২টি হত্যা মামলায় জড়িত ১,৪৮৭ জন এবং নাশকতা সংশ্লিষ্ট মামলায় আরও ১৫৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে বলেও জানান তিনি।
এদিন পুলিশ সপ্তাহের দ্বিতীয় দিনের কার্যক্রমেও বেশ কয়েকটি পুলিশ ইউনিট, যেমন—সিআইডি, পিবিআই, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ নিজেদের কার্যক্রম ও চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে। এসব ইউনিটের প্রতিনিধিরা বাজেট ঘাটতি, জনবল সংকট ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা সম্পর্কেও বিশদে কথা বলেন।
বাজেট ঘাটতি ও জনবল সংকটের বাস্তব চিত্র
বৈঠকে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. নাজমুল করিম খান বলেন, তার ইউনিটে মাত্র ১,১৬৯ জন কর্মকর্তা রয়েছেন, যাদের প্রত্যেককে গড়ে ২৮৮ জন নাগরিকের দায়িত্ব পালন করতে হয়। তিনি ইউনিটে আরও ২,৪২৮ জন জনবল বৃদ্ধির প্রস্তাব দেন। ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি আতাউল কবির জানান, রিজার্ভ ফোর্স না থাকায় জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত সাড়া দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি অবিলম্বে রিজার্ভ ফোর্স গঠনের দাবি জানান।
সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি রোমানা আক্তার প্রতিটি বিভাগে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন এবং হাই-টেক অপরাধ মোকাবেলায় আধুনিক প্রযুক্তির প্রস্তাব দেন। হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি এএফএম আখতারুজ্জামান বসুনিয়া তার ইউনিটে ছয় হাজার নতুন পদ সৃষ্টির প্রস্তাব দেন। শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, শ্রমঘন এলাকাগুলোর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কিছু শ্রম আইন সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আনিসুজ্জামান পর্যাপ্ত তহবিলের অভাবে তদন্ত কার্যক্রমে বিলম্ব হয় বলে জানান। চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম শান্ত বলেন, কর্মকর্তাদের ওভারটাইম এবং যাতায়াত ভাতা না থাকায় মনোবল কমে যাচ্ছে। তিনি এ দুই ধরনের ভাতা চালুর সুপারিশ করেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের হাউজিং বিভাগের এআইজি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পুলিশের আবাসন সমস্যা এখনও প্রকট। তিনি গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে বিশেষ অবকাঠামো বরাদ্দ চেয়েছেন।
সংস্কারে মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের আশ্বাস
সরকারের উপদেষ্টারা পুলিশ বাহিনীর এসব প্রস্তাবকে ইতিবাচকভাবে নেন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রমে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন। আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘পুলিশের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রয়োজনীয় নীতিগত সংস্কার কার্যকর করা হবে।’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে, তবে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছাতে হলে আরও অনেক সংস্কার দরকার। গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, ‘পুলিশকে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব বাদ দিয়ে জনগণের আরও কাছাকাছি আসতে হবে।’ আইসিটি উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, পুলিশের কার্যক্রমে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করার মাধ্যমে জনসেবা আরও কার্যকর করা সম্ভব এবং এ লক্ষ্যে আইসিটি বিভাগ থেকে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
আলোচিত অনুসন্ধানে অগ্রগতি
বৈঠকে সিআইডির অতিরিক্ত আইজিপি গাজী জসিম ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে সিআইডির কার্যক্রম উপস্থাপন করেন। তিনি জানান, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গঠিত একটি অনুসন্ধান কমিটি ইতোমধ্যে এক হাজার কোটি টাকার বেশি অবৈধ সম্পদের সন্ধান পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রায় ৫,৮০০ শতক জমি। যেসব ব্যবসায়িক গ্রুপ বর্তমানে তদন্তের আওতায় রয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে—এস আলম, বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, নাবিল, ইউনিক ও সিকদার গ্রুপ।
সব মিলিয়ে এ সেমিনার এবং পুলিশ সপ্তাহের বিভিন্ন অধিবেশন থেকেই প্রতীয়মান, বাংলাদেশে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং আধুনিকায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যথাযথ অর্থায়ন, কাঠামোগত সংস্কার এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা অপরিহার্য।
বাংলাবার্তা/এমএইচ