
ছবি: সংগৃহীত
মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধ, নিরাপত্তাহীনতা এবং নাগরিক অধিকারের অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে অবস্থানরত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বর্তমানে কার্যকরভাবে সম্ভব নয় বলে স্পষ্ট মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।
রোববার (৪ মে) রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত একটি উচ্চপর্যায়ের সেমিনারে বক্তৃতাকালে এ মন্তব্য করেন তিনি। সেমিনারের শিরোনাম ছিল, “বাংলাদেশে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: আঞ্চলিক নিরাপত্তায় কৌশলগত প্রভাব ও ভবিষ্যৎ পথ”।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “মিয়ানমারে বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজ করছে, সেটি কোনোভাবেই নিরাপদ পরিবেশের সংজ্ঞায় পড়ে না। সেখানে এখন একটি গৃহযুদ্ধ চলছে, কোনো কার্যকর রাষ্ট্রীয় কাঠামো নেই, বরং বিভক্ত রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির মধ্যে সংঘাত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলো এখনও অনুপস্থিত।”
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ও কূটনৈতিক ব্যর্থতা
রোহিঙ্গা ইস্যুতে গত প্রায় সাত বছর ধরে বাংলাদেশ বিভিন্ন স্তরে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলেও আজও একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। উপদেষ্টা বলেন,
“দীর্ঘদিন আমরা দ্বিপাক্ষিক কূটনীতির ওপর নির্ভর করেছি। কিন্তু শুরু থেকেই আমরা সতর্ক করেছিলাম যে মিয়ানমারের সঙ্গে শুধু দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই আশঙ্কাই আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে।”
তিনি দ্বিপাক্ষিক প্রক্রিয়াকে "বৃথা" আখ্যা দিয়ে বলেন, “আমরা কূটনীতি ত্যাগ করতে পারি না, কিন্তু এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে যে, কেবলমাত্র আলোচনার মাধ্যমে একটি নৃশংস রাষ্ট্র তার দায়িত্ব স্বীকার করে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে।”
২০১৭ সালের রোহিঙ্গা ঢল এবং পূর্ব ইতিহাস
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ চালানো অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর ফলে কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় গড়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির।
উপদেষ্টা স্মরণ করিয়ে দেন, “রোহিঙ্গা সমস্যা নতুন কিছু নয়। এর আগেও ১৯৭৮ ও ১৯৯১ সালে দুই দফায় প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছিল। কিন্তু ২০১৭ সালের পরিমাণ এবং পরিণতি ছিল আরও ভয়াবহ ও দীর্ঘমেয়াদি।”
প্রত্যাবাসনের প্রধান শর্ত—নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা
মো. তৌহিদ হোসেন জোর দিয়ে বলেন, “কোনো প্রত্যাবাসনই বাধ্যতামূলক হতে পারে না। এটি হতে হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদ এবং মর্যাদার সঙ্গে। এর জন্য মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের বসবাসের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “রোহিঙ্গারা এমন জায়গায় ফিরে যেতে পারে না যেখানে তাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে থাকবে এবং তারা নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। বর্তমানে রাখাইন রাজ্যের যেসব জায়গা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দখলে রয়েছে, সেখানে তারা ফেরত যেতে চায় না। কারণ তারা জানে, সেখানে ফেরার অর্থ আবারও নির্যাতনের মুখে পড়া।”
মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ ও নতুন শক্তির উত্থান
উপদেষ্টা বলেন, “মিয়ানমার কখনোই প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল না। এমনকি অং সান সু চি’র অধীনে নির্বাচিত সরকারও আসলে এক ধরনের আধা-সামরিক শাসন চালাতো। কিন্তু বর্তমানে দেশটিতে যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তা হলো পুরোমাত্রায় গৃহযুদ্ধ। কেন্দ্রীয় জান্তা সরকার, আরাকান আর্মি ও ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি)—এই তিন পক্ষ এখন মিয়ানমারে শক্তি প্রদর্শন করছে।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “যেকোনো স্থায়ী সমাধান পেতে হলে এই তিনটি পক্ষকে সমানভাবে আলোচনায় আনতে হবে। বিশেষ করে আরাকান আর্মি এখন রাখাইন রাজ্যের বৃহৎ অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের বাদ দিয়ে কোনো বাস্তব সমাধান সম্ভব নয়।”
আঞ্চলিক নিরাপত্তায় এর প্রভাব
উক্ত সেমিনারে অংশ নেওয়া সামরিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলেন, দীর্ঘমেয়াদে রোহিঙ্গা ইস্যুটি শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য একটি নিরাপত্তা হুমকি হয়ে উঠছে।
রোহিঙ্গাদের শিক্ষা ও জীবিকার অনিশ্চয়তা, ক্যাম্পে চরম জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং অপরাধচক্রের সক্রিয়তা—এসব মিলিয়ে পরিস্থিতি দিন দিন আরো জটিল হয়ে উঠছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, “অবিলম্বে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত কেবল মানবিক সহায়তার সীমা অতিক্রম করে রাজনৈতিক সমাধানে সক্রিয় হওয়া। জাতিসংঘ, আসিয়ান, চীন ও ভারতসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আরও প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে হবে।”
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ এখনো কণ্টকাকীর্ণ। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের বক্তব্য একটি বাস্তবতাভিত্তিক কণ্ঠস্বর—যেখানে কেবল কূটনৈতিক সৌজন্য নয়, রয়েছে সমস্যার গভীর বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যৎ পথের সন্ধান। বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ এবং মিয়ানমারের জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে একটি বাস্তবসম্মত, বহুপক্ষীয় ও টেকসই সমাধানের পথেই অগ্রসর হওয়া এখন জরুরি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ