
ছবি: সংগৃহীত
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার দীর্ঘদিনের সীমান্ত উত্তেজনা ফের ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। নিয়ন্ত্রণরেখা (LoC) বরাবর বিগত এক দশকে অন্যতম বড় গোলাগুলির ঘটনায় দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। আর এই পরিস্থিতির সূত্রপাত হয়েছে পাকিস্তানি এক রেঞ্জারকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কর্তৃক আটকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য রাজস্থানের আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে ওই রেঞ্জারকে আটক করার পরই সীমান্তজুড়ে শুরু হয় একের পর এক গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা, যার বিস্তার ঘটে জম্মু ও কাশ্মির পর্যন্ত।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম NDTV-এর খবরে বলা হয়, শনিবার (৩ মে) রাজস্থানের আন্তর্জাতিক সীমান্ত এলাকা থেকে পাকিস্তানের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এক সদস্যকে আটক করে বিএসএফ। তবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত ওই রেঞ্জারের পরিচয় প্রকাশ করেনি। তিনি বর্তমানে বিএসএফের রাজস্থান ফ্রন্টিয়ারের হেফাজতে রয়েছেন।
এই ঘটনাটি ঘটে এমন এক সময়ে, যখন পাকিস্তান নিজেও এক ভারতীয় বিএসএফ কনস্টেবল পূর্ণম কুমার সাহুকে আটক করে রেখেছে। গত ২৩ এপ্রিল পাঞ্জাবের ফিরোজপুর সেক্টরে কৃষকদের নিরাপত্তায় নিযুক্ত থাকা অবস্থায় সাহু ভুলবশত সীমান্ত অতিক্রম করলে পাকিস্তান তাকে আটক করে। তাকে এখনও ফেরত পাঠানো হয়নি।
পাকিস্তানি রেঞ্জার আটকের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নিয়ন্ত্রণরেখার বিভিন্ন সেক্টরে পাক সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ‘বিনা উসকানিতে’ গুলি বর্ষণের অভিযোগ এনেছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। গোলাগুলির এই ঘটনা একদিনের নয়—এর আগে টানা ১০ দিন ধরে সীমান্তে উত্তেজনা চলছিল, যার ধারাবাহিকতায় এখন তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
ভারতের সেনাবাহিনী সূত্র জানায়, কাশ্মিরের কুপওয়ারা, বারামুলা, পুঞ্চ, রাজৌরি, মেন্ধর, নৌশেরা, সুন্দরবানি এবং আখনুর সেক্টরে ব্যাপক গুলি চালানো হয়। ভারতীয় বাহিনীও পাল্টা জবাব দিয়েছে বলে জানানো হয়। এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষের তরফে প্রাণহানির খবর নিশ্চিতভাবে পাওয়া না গেলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
ভারতের এক সেনা কর্মকর্তা জানান, "এই হামলায় একযোগে যতগুলো পাকিস্তানি পোস্ট অংশ নিয়েছে, তা সাম্প্রতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন। আমাদের সেনারা যথাযথ জবাব দিচ্ছে।"
কাশ্মির অঞ্চলে এ সংঘর্ষ এমন এক সময়ে ঘটছে, যখন মাত্র কয়েকদিন আগে জম্মু ও কাশ্মিরের পেহেলগামে ভয়াবহ এক সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৬ জন। এটি ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর সবচেয়ে বড় প্রাণঘাতী হামলা বলে মনে করা হচ্ছে। ওই হামলায় বেসামরিক নাগরিক এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা নিহত হন।
এই হামলার দায় ভারত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাকিস্তান-সমর্থিত জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর ওপর চাপালেও ইসলামাবাদ তা অস্বীকার করেছে। তবে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে একাধিক কড়া কূটনৈতিক পদক্ষেপ।
ভারত সিন্ধু নদী জলবণ্টন চুক্তি স্থগিত করার ঘোষণা দেয়। এই চুক্তি ১৯৬০ সালে উভয় দেশের মধ্যে সই হয়েছিল, যা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে একটি মৌলিক কাঠামো নির্ধারণ করে দিয়েছিল। জবাবে পাকিস্তানও পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ঐতিহাসিক সিমলা চুক্তি স্থগিতের কথা জানায় এবং ভারতীয় উড়োজাহাজের জন্য নিজেদের আকাশসীমা বন্ধ করারও হুমকি দেয়।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই কূটনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনার মাঝেই পাকিস্তান শনিবার ‘আবদালি’ নামের একটি স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ চালিয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী জানায়, এটি "সিন্ধু মহড়া"র অংশ হিসেবে করা হয়েছে এবং এর পাল্লা ৪৫০ কিলোমিটার।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এ পরীক্ষাকে “খোলামেলা উসকানি” এবং “অস্থির পরিবেশকে আরও উত্তপ্ত করার কৌশল” বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, “এই ধরনের পদক্ষেপ স্পষ্ট করে দেয়, পাকিস্তান উত্তেজনা প্রশমনের পরিবর্তে সংঘাতের পথেই আগ্রসর হচ্ছে।”
সীমান্তে অনেক সময় দুই দেশের সৈন্য ভুল করে পারাপার হলে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে তাদের দ্রুত ফেরত দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু এবারে উভয় দেশই প্রতিপক্ষের আটক সদস্যকে ফেরত দিতে অনিচ্ছুক। পাকিস্তান পূর্ণম কুমার সাহুর বিষয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট সময়সীমা জানায়নি। অন্যদিকে ভারতও এখন পাকিস্তানি রেঞ্জারকে ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখেছে।
বর্তমান পরিস্থিতি একদিকে সীমান্তে ভয়াবহ সংঘর্ষ এবং অন্যদিকে কূটনৈতিক স্তরে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে রূপ নিয়েছে। কাশ্মির ইস্যু, জঙ্গি হামলা, সৈন্য আটক এবং ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা—সব মিলিয়ে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে আবারও নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এই উত্তেজনা সামাল দেওয়া না গেলে তা দুদেশের সম্পর্ককে আরও নাজুক করে তুলবে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ