
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের দীর্ঘমেয়াদী অবরোধ এবং যুদ্ধপরিস্থিতির কারণে সেখানে মানবিক বিপর্যয় চরম আকার ধারণ করেছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরাইলি সেনা অভিযানের মধ্যে এখন পর্যন্ত গাজা শহর এবং আশপাশের অঞ্চলে সাহায্য প্রবেশ বন্ধ থাকায় খাদ্য ও ওষুধ সংকট চরমে পৌঁছেছে। এই সংকটের প্রেক্ষাপটে এখন পর্যন্ত অনাহারে মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে ৫৭ জন ফিলিস্তিনির, যাদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিরবতা এবং পর্যাপ্ত মানবিক সহায়তা না পৌঁছানোর কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশ। আলজাজিরার খবরে বলা হয়েছে, কাতার এক বিবৃতিতে ইসরাইলের বক্তব্যকে ‘রাজনৈতিক ও নৈতিক দায়িত্বহীনতা’ বলে অভিহিত করেছে এবং আন্তর্জাতিক মহলকে অবিলম্বে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছে।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম 'এক্স'-এ (সাবেক টুইটার) একটি পোস্টে লিখেছেন, ইসরাইল গাজার ওপর যে আগ্রাসন চালাচ্ছে, তাকে ‘সভ্যতা রক্ষা’ হিসেবে উপস্থাপন করাটা ইতিহাসের সেই অধ্যায়গুলোর মতোই, যেখানে শক্তিধর শাসকগোষ্ঠীগুলো নিরীহ নাগরিকদের ওপর বর্বরতা চালিয়ে তা বৈধতা দেওয়ার জন্য বিকৃত বর্ণনা ব্যবহার করেছে। তিনি লেখেন, “গাজার সাধারণ মানুষ আধুনিক বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটি কি তাহলে ‘সভ্যতার মডেল’?”
অন্যদিকে, গাজায় সাহায্য পৌঁছে দিতে চেষ্টারত ফ্রিডম ফ্লোটিলা নামে একটি আন্তর্জাতিক জোটের জাহাজ বর্তমানে মাল্টার উপকূলে আটকে আছে। তারা জানিয়েছে, ড্রোন হামলার কারণে জাহাজটি সমুদ্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং নোঙরের অনুমতি পাচ্ছে না। এতে থাকা চারজন স্বেচ্ছাসেবক সামান্য আহত হলেও নিরাপত্তার অভাবে জাহাজটি কোনো নিরাপদ বন্দরে যেতে পারছে না। ফ্লোটিলা জোটের এক সদস্য, অভিনেত্রী ও মানবাধিকারকর্মী নিকোল জেনেস জানান, “কেউ আমাদের সাহায্য করছে না। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অনুরোধ করছি আমাদের ক্রুদের নিরাপদে তীরে পৌঁছাতে সহায়তা করতে, যাতে অন্তত গাজার মানুষের জন্য আনা সাহায্য পৌঁছে দিতে পারি।”
তিনি আরও বলেন, “শুক্রবার ও শনিবার আমাদের একদল স্বেচ্ছাসেবক জাহাজে ওঠার চেষ্টা করলে মাল্টার কর্তৃপক্ষ তাদের বাধা দেয় ও গ্রেফতারের হুমকি দেয়। যাঁরা জাহাজে রয়েছেন, তাঁদের বিদ্যুৎ নেই, এবং তাঁরা আরেকটি হামলার আশঙ্কায় রয়েছেন।”
গাজার পরিস্থিতি এতটাই সংকটাপন্ন যে, মানবাধিকার সংস্থাগুলো সতর্ক করে বলেছে—অনাহার এবং চরম দারিদ্র্যের কারণে সমাজে আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে পারে। সাহায্য সংস্থাগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী, সম্প্রতি শহরাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে লুটপাটের ঘটনা, যা এর আগে সীমিত অঞ্চলেই ঘটতো। এতে স্পষ্ট প্রতিফলিত হচ্ছে, গাজার মানুষের দুর্দশা এখন এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে জীবনধারণের জন্য ক্ষুধার্ত মানুষ বাধ্য হচ্ছে সহিংস পথে যেতে।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মার্চ মাসে ঘোষণা দিয়েছিলেন, হামাসের সঙ্গে কোনো যুদ্ধবিরতি নয়, বরং সামরিক অভিযানের মাধ্যমে গাজাকে ‘নিরাপদ’ করতে হবে। সেই থেকে ইসরাইল গাজা উপত্যকায় কোনো ধরনের মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। খাদ্য, পানি, ওষুধ এমনকি জরুরি চিকিৎসাসেবা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা UNRWA জানিয়েছে, গাজা সিটির তাদের ফিল্ড অফিসে বুধবার হাজার হাজার মানুষ ঢুকে পড়ে ওষুধ গ্রহণ করে—তাদের কর্মীদের হুমকির মুখে সরিয়ে নিতে হয়েছে। সংস্থার জ্যেষ্ঠ জরুরি কর্মকর্তা লুইস ওয়াটারিজ বলেন, “এই ঘটনাগুলো শুধু নিরাপত্তাহীনতার প্রতিচ্ছবি নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে চলা বঞ্চনার সরাসরি প্রতিক্রিয়া। মানুষ আর সহ্য করতে পারছে না।”
এই প্রেক্ষাপটে মানবিক সহায়তা সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়াকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং আরব লিগের কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্র ইসরাইলের আচরণের কড়া সমালোচনা করেছে। তবে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা এখনো নেওয়া হয়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, গাজায় এখন যা চলছে, তা কেবল একটি সংঘাত নয়, বরং সুপরিকল্পিতভাবে একটি জনগোষ্ঠীকে দমন ও নিধনের কৌশল, যা আন্তর্জাতিক নীতিনৈতিকতা ও মানবাধিকারের মুখে চরম চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ