
ছবি: সংগৃহীত
বিগত আট মাসে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দলে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অন্তত ৫৮ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। রাজনৈতিক দল হিসেবে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির অভ্যন্তরে যে বিপুল অস্থিরতা ও নেতৃত্বহীনতা বিরাজ করছে, তারই ফলাফল হিসেবে এসব সহিংসতার ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। পরিস্থিতি এতটাই উদ্বেগজনক যে, একমাত্র এপ্রিল মাসেই অন্তত সাতজন নেতাকর্মী বিভিন্ন জেলার সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন।
বিএনপির এই ধ্বংসাত্মক সহিংসতার পেছনে অর্থনৈতিক স্বার্থ, দলে প্রভাব বিস্তার এবং আসন্ন নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রস্তুতিকে মূল কারণ হিসেবে দেখছেন গবেষকরা। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত আট মাসে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় মোট ৭৬ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৫৮ জনই বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের শিকার। শুধু জানুয়ারি-মার্চ সময়ের মধ্যেই ২৬ জন নেতাকর্মী মারা গেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, “এই সহিংসতাগুলোর পেছনে মূলত রয়েছে অর্থনৈতিক স্বার্থ, নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াই এবং দলীয় অবস্থান পাকাপোক্ত করার চেষ্টা। নির্বাচনের আগমুহূর্তে এসব সংঘাত আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “বিএনপি গত ১৭-১৮ বছর ক্ষমতার বাইরে। চেয়ারপারসন কার্যত নিষ্ক্রিয়, আর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন বিদেশে। এই নেতৃত্ব শূন্যতায় দলে সংহতি ভেঙে পড়েছে। ফলে নেতাকর্মীরা নিজেদের বলয়কে রক্ষা করতে গিয়ে সংঘাতে জড়াচ্ছে।”
গত ৫ এপ্রিল রংপুরের বদরগঞ্জে আধিপত্য বিস্তার ও একজন ব্যবসায়ীকে মারধরের প্রতিবাদে ডাকা মানববন্ধনে বিএনপির দু’পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন দলটির নিবেদিত কর্মী মো. লাভলু মিয়া। তার ছেলে রায়হান কবির জানান, তার বাবা বিএনপির হয়ে জেল খেটেছেন, গুলিবিদ্ধও হয়েছেন। “অথচ নেতারা কেউ পাশে আসেননি,” বলেন তিনি।
রায়হান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “যারা হত্যা করেছে, তারা আগাম জামিন নিয়েছে টাকার জোরে। দলের কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। এই যদি হয় রাজনীতি, তাহলে কাউকে বলবো না রাজনীতি করতে।”
ঘটনার পর ছয়জন নেতাকে বহিষ্কার করলেও, স্থানীয় পর্যায়ে অভিযুক্তদের প্রভাব কমেনি বলে দাবি করেন নিহতের পরিবার।
১১ এপ্রিল গাজীপুরের ধীরাশ্রম এলাকায় কৃষকদলের নেতা রাকিব মোল্লাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরিবার জানায়, ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসায় আধিপত্যকে কেন্দ্র করে বিএনপির অন্তর্কোন্দলের কারণেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটে।
রাকিবের মা রুবিনা আক্তার সীমা বলেন, “আমার ছেলে দলের ভেতরে উন্নতির পথে ছিল। তাই তাকে খুন করা হয়েছে। খুনিরা বিএনপির আশ্রয়ে আছে, অনেকে চায় না মামলাটা এগোক।” তিনি প্রশ্ন তোলেন, “তবে কি বিএনপির লোকজন অপরাধ করলে মাফ পায়?”
দলীয় সহিংসতার দায় এড়াননি বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “সংঘাত হচ্ছে না, এটা বলবো না। তবে কাউকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে না। জড়িতদের শোকজ, বহিষ্কার এবং কমিটি বিলুপ্ত করা হচ্ছে।” তিনি আরও জানান, এ পর্যন্ত প্রায় ৩-৪ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তবে তিনি এসব ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক নিপীড়নের দীর্ঘ ইতিহাসকে দায়ী করে বলেন, “দলটি গত ১৫-১৬ বছর ধরে দমন-পীড়নের শিকার হয়েছে। সেই রাজনৈতিক ক্ষতেরই প্রতিক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ পাচ্ছে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির ভেতরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, বেপরোয়া প্রতিযোগিতা এবং দলীয় কাঠামোর দুর্বলতা একে সংকটময় অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে। মহিউদ্দিন আহমদের মতে, “চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে সাংগঠনিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে। স্থানীয় নেতারা এখন নিজস্ব বলয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চাইছে।”
তিনি আরও বলেন, “নির্বাচনের আগমুহূর্তে সবাই প্রার্থী হতে চায়। নিজের বলয়কে শক্তিশালী করতে গিয়ে সহিংসতাই একমাত্র পথ মনে করে অনেকে।”
কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে জোর করে দখল ও অর্থনৈতিক লোভের চর্চা বহু পুরোনো। এই সহিংসতা সেই সংস্কৃতিরই ধারাবাহিকতা।”
বিশ্লেষকদের মতে, যেসব নেতাকর্মী তৃণমূলে সহিংসতা চালাচ্ছেন, তাদের অনেকেরই পেছনে রয়েছে জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রশ্রয়। এদের দমন না করলে নির্বাচন সামনে রেখে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হতে পারে।
অধ্যাপক মারুফ বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ভেঙে পড়লে সেটি জাতীয় রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ডেকে আনে। দলের জন্য নিবেদিত কর্মীরা তখন হতাশ হন, দলও জনসমর্থন হারায়।”
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি বর্তমানে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, নেতৃত্বহীনতা ও স্থানীয় পর্যায়ের সহিংসতার ভয়াবহ চাপে রয়েছে। দলের মাঠ পর্যায়ে সংঘর্ষ, হত্যা, দখলবাজি এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি যেভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে, তাতে আগামী নির্বাচনে সংগঠন হিসেবে বিএনপির টিকে থাকাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। দলের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা না গেলে, শুধু সাংগঠনিক ক্ষতি নয়, বরং এটি জাতীয় রাজনীতিতেও গভীর অস্থিরতা ডেকে আনতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ