ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমানে একটি গভীর অচলাবস্থা বিরাজ করছে। নির্বাচন, সংস্কার এবং গণহত্যা ও ফ্যাসিবাদে জড়িতদের বিচার এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার দাবিকে কেন্দ্র করে মূলত দেশের প্রধান প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। একদিকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং তাদের মিত্ররা, অন্যদিকে রয়েছে সরকারপক্ষ ও কিছু ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক শক্তি—এই দুই মেরুর মধ্যে মতবিনিময়ের প্রচেষ্টা চললেও, এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর সমঝোতা হয়নি।
বিগত কয়েক মাস ধরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ধারাবাহিক বৈঠক হলেও কোনো দলই তিনটি মূল ইস্যু—নির্বাচনের সময় ও পদ্ধতি, সংবিধান ও রাষ্ট্র কাঠামোতে সংস্কার, এবং যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার বিচারের প্রশ্নে—অন্য দলের অবস্থানের সঙ্গে পুরোপুরি একমত হতে পারেনি। একইসঙ্গে সরকারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখলেও, কার্যত কোনো পক্ষ একচুল নড়তে রাজি নয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বড় দলগুলো এখনও দলীয় স্বার্থ ও আদর্শের বাইরে গিয়ে রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে আপস করতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে কোনো একটি পক্ষের উদারতা ছাড়া ঐকমত্য গড়ে তোলা কঠিন।
নির্বাচন: সময়, পদ্ধতি ও কাঠামোতে বিভেদ
বিএনপি: ডিসেম্বরে নির্বাচন, বিদ্যমান পদ্ধতি বহাল
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দলটি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন চায়। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন যেন তার আগে না হয়, সে দাবিও তাদের। বিএনপি বিদ্যমান 'ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট' পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানে আগ্রহী এবং সংখ্যাগত বা আনুপাতিক (পিআর) পদ্ধতির ঘোর বিরোধী।
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জাতীয় নির্বাচন হতে পারে ফেব্রুয়ারির মধ্যেই, কিন্তু এপ্রিল পার হওয়া উচিত নয়। দলটি নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় এবং পিআর পদ্ধতির ঘোর সমর্থক।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আরও ভিন্ন এক অবস্থানে। তারা চায় গণপরিষদ নির্বাচন আগে হোক এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে জাতীয় নির্বাচন হোক পরে। এনসিপিও পিআর পদ্ধতির সমর্থক। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম স্পষ্টভাবে বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে এবং নৌকা মার্কা বাতিল করে দিতে হবে।
সংস্কার ইস্যুতে তিনটি দলের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্নতর—
বিএনপি ও জামায়াত: জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় ও গ্রহণযোগ্য কিছু সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করার পক্ষে। তারা একটি "জাতীয় সনদে" দলগুলোর স্বাক্ষরের প্রস্তাব দিয়েছে, যা নিয়ে পরে নির্বাচিত সরকার আরও আলোচনা করতে পারবে।
এনসিপি: তারা শুধু সংস্কার নয়, বরং মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তন চায়। বর্তমান সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি তুলেছে তারা।
বামপন্থী ও ইসলামী দলের একাংশ সংস্কার কমিশনের বিভিন্ন প্রস্তাব যেমন এক ব্যক্তি একাধিক পদে না থাকতে পারা বা প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ২ মেয়াদের বেশি না হওয়া—এসবের প্রতি সমর্থন জানালেও বিএনপি এইসব প্রস্তাবকে ‘অন্তর্বর্তী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’ বলে মনে করছে এবং সেসব বিষয়ে আপস করতে নারাজ।
এনসিপির দাবি আরও আগ্রাসী। তারা শুধু বিচারের দাবিই নয়, বরং সরকারের দায়িত্বপালন চলাকালে আওয়ামী লীগকে সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছে। এনসিপির সমাবেশে বলা হয়েছে, "৫ আগস্ট জনতা আওয়ামী লীগকে লাল কার্ড দেখিয়ে দিয়েছে। দলটিকে নিষিদ্ধ করতেই হবে।"
বিএনপির ভাষ্য তুলনামূলকভাবে কৌশলী। তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিলের কথা জানালেও দল নিষিদ্ধ করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর ছেড়ে দিচ্ছে।
জামায়াতও বিচার চায়, তবে নিষিদ্ধ ঘোষণার দায়িত্ব সরকারের বলে মনে করে।
এনসিপি যেখানে পুরোপুরি নতুন সংবিধানের কথা বলছে, বিএনপি তা প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা মনে করে, বিদ্যমান সংবিধানের মধ্যেই নির্বাচনসহ অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন হতে পারে। এনসিপির এই একক অবস্থানেই অন্যান্য দলের সঙ্গে তাদের মতবিরোধ গভীর হয়েছে।
সংসদ নেতা, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন নিয়েও ভিন্নমত—
বিএনপি মনে করে এসব রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়, আইন করে নির্ধারণ করা অনুচিত।
জামায়াত মনে করে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা এক ব্যক্তি হতে পারেন, তবে দলের প্রধান আলাদা কেউ হলেও সমস্যা নেই।
বাম ও ইসলামি দলগুলোর বড় অংশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, একাধিক ইস্যুতে মতপার্থক্য থাকলেও আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে একটি ন্যূনতম ঐকমত্য হচ্ছে—বর্তমান সরকার, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, দেশে দমন-পীড়নের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছে এবং তাদের শাসনের নৈতিক ভিত্তি নেই। তবে ফ্যাসিবাদবিরোধী অবস্থান যতই এক হোক, নির্বাচন ও সংস্কারের কৌশলগত ইস্যুতে বিভক্ত থাকলে ঐক্য ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, “প্রত্যেক দল নিজ নিজ অবস্থান থেকে দাবিগুলো তুলে ধরছে। কোনো দলই চায় না তাদের অবস্থানকে অন্যদের কারণে বিসর্জন দিতে। তবে ফ্যাসিবাদবিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে হলে কিছু বিষয়ে আপস করতেই হবে।”
নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণ, বিদ্যমান নির্বাচনী কাঠামো সংস্কার এবং গণহত্যা-ফ্যাসিবাদে জড়িতদের বিচার—এই তিন ইস্যুতে মতপার্থক্য যত দীর্ঘায়িত হবে, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা তত বাড়বে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পরিস্থিতি নিরসনে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও উদারতা দিয়ে একটি অভিন্ন ন্যূনতম রূপরেখায় পৌঁছায়, যার ভিত্তিতে নির্বাচন, বিচার ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ গড়ার পথ সুগম হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



