
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রপ্তানি খাত বিশ্বব্যাপী দেড় শতাধিক দেশে বিস্তৃত হলেও প্রকৃত আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ আসে মাত্র ১০টি দেশ থেকে। অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ তথ্যটি ইঙ্গিত দিচ্ছে, বাংলাদেশ এখনও বাজার বৈচিত্র্যে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। বরং সময়ের সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু দেশের ওপর নির্ভরতা বেড়েই চলেছে। ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি বা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো অস্থিরতা দেখা দিলে তার সরাসরি চাপ পড়ে দেশের রপ্তানি খাতে। বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে এ ঝুঁকির কথা বলে আসছেন।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কয়েকটি দেশ, যুক্তরাজ্য, জাপান ও কানাডা—এই কয়েকটি দেশই বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের মূল উৎস। এককভাবে যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা শীর্ষে রয়েছে। এর বাইরে ইইউর জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইতালি ও বেলজিয়াম বড় অংশ দখল করে আছে। এছাড়া উত্তর আমেরিকায় কানাডা এবং এশিয়ায় জাপান বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি বাজার।
সব দেশেই প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক (রেডিমেড গার্মেন্টস বা আরএমজি)। ফলে বাজার যেমন সীমিত, তেমনি পণ্য বৈচিত্র্যও প্রায় নেই। ইউরোপ ও আমেরিকার ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকায় রপ্তানিকারকরা নতুন বাজারে যেতে খুব একটা আগ্রহী নন। উদাহরণ হিসেবে বিজিএমইএর একজন সাবেক সভাপতির কারখানা প্রতিষ্ঠার পর থেকে টানা ৫০ বছর ধরে কেবল একটি ব্রিটিশ ব্র্যান্ডে পণ্য সরবরাহের উদাহরণ টানা যায়।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, কোনো দেশের বাজারে এতটা নির্ভরশীলতা এক ধরনের দায়বদ্ধতা তৈরি করে। ফলে ওই দেশ হঠাৎ শুল্ক আরোপ করলে বা রাজনৈতিক টানাপোড়েন দেখা দিলে রপ্তানি হ্রাসের ঝুঁকি তৈরি হয়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ইস্যুতে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, তা স্পষ্ট করে দিয়েছে কীভাবে একটি বাজারে অস্থিরতা গোটা রপ্তানি খাতকে নাড়িয়ে দিতে পারে। আবার কোনো দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে আমদানি কমে যায়, তাতেও বিপাকে পড়ে রপ্তানিকারকরা। করোনাভাইরাস মহামারির সময় ইউরোপ ও আমেরিকায় চাহিদা কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের পোশাক খাত বড় ধাক্কা খায়।
যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি
দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য। গত অর্থবছরে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে ৮৬৯ কোটি ডলারের, যা মোট রপ্তানির প্রায় ১৮ শতাংশ। আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ শতাংশ। শুধু ওভেন ক্যাটাগরির পোশাক—শার্ট ও প্যান্ট জাতীয় পণ্যের রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৪৯৫ কোটি ডলার, নিট ক্যাটাগরির (গেঞ্জি, সোয়েটার ইত্যাদি) রপ্তানি ছিল ২৬০ কোটি ডলার। এছাড়া টুপি রপ্তানি হয়েছে ২৬ কোটি ডলার এবং হোমটেক্সটাইল ১৭ কোটি ডলারের মতো।
জার্মানি দ্বিতীয়
ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানি গন্তব্য। গত অর্থবছরে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে ৫২৯ কোটি ডলার, যা মোট রপ্তানির প্রায় ১১ শতাংশ। জার্মানিতে নিটওয়্যার সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এই খাত থেকে আয় হয়েছে ৩০৬ কোটি ডলার। ওভেন পোশাক থেকে এসেছে প্রায় ১৮৯ কোটি ডলার। আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ শতাংশের বেশি।
যুক্তরাজ্য তৃতীয়
তৃতীয় স্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য। ব্রেক্সিটের পর একক বাজার হিসেবে দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে। গত অর্থবছরে যুক্তরাজ্যে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৪৬২ কোটি ডলার, যা মোট রপ্তানির প্রায় ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক হলেও বাইসাইকেল ও হোম টেক্সটাইলও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রপ্তানি হয়। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ শতাংশের বেশি।
স্পেন চতুর্থ
চতুর্থ বৃহত্তম বাজার স্পেন, যেখানে রপ্তানির পরিমাণ ৩৫৫ কোটি ডলার। এখানে প্রধানত নিটওয়্যার পণ্যের চাহিদা বেশি। নিট পোশাক থেকে আয় হয়েছে প্রায় ১৯৫ কোটি ডলার, ওভেন পোশাক থেকে ১৪৫ কোটি ডলার। চামড়া ও পাদুকাও স্পেনে রপ্তানির তালিকায় আছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ শতাংশের বেশি।
ফ্রান্স পঞ্চম
ফ্রান্স বাংলাদেশের পঞ্চম রপ্তানি বাজার। গত অর্থবছরে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে ২৪২ কোটি ডলার। নিটওয়্যার থেকে আয় হয়েছে ১৩২ কোটি ডলার, ওভেন থেকে প্রায় ৪৩ কোটি ডলার। হোম টেক্সটাইল ও ফুটওয়্যারও এখানে জনপ্রিয়।
নেদারল্যান্ডস ষষ্ঠ
ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে নেদারল্যান্ডস। দেশটিতে গত অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ২৩৫ কোটি ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২২ শতাংশ বেশি। নিট পোশাক, ওভেন পোশাক, হোমটেক্সটাইল এবং পাদুকা এখানকার প্রধান পণ্য।
ইতালি সপ্তম
ইতালি সপ্তম প্রধান বাজার। দেশটিতে গত অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১৬৬ কোটি ডলার। এর মধ্যে নিটওয়্যার থেকে এসেছে ৯৬ কোটি ডলার, ওভেন থেকে ৫৮ কোটি ডলার। চামড়া, হোমটেক্সটাইল ও ফুটওয়্যারও রপ্তানির তালিকায় রয়েছে।
কানাডা অষ্টম
অষ্টম অবস্থানে কানাডা। দেশটিতে গত অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১৪৬ কোটি ডলার। প্রধান পণ্য নিটওয়্যার, ওভেন পোশাক ও হোম টেক্সটাইল। আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ শতাংশের বেশি।
জাপান নবম
এশিয়ার মধ্যে জাপান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার, অবস্থান নবম। গত অর্থবছরে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১৪১ কোটি ডলার, যা মোট রপ্তানির প্রায় ৩ শতাংশ। এখানে নিট ও ওভেন পোশাকের পাশাপাশি চামড়া, পাদুকা ইত্যাদি রপ্তানি হয়। প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৭ শতাংশ।
বেলজিয়াম দশম
ইইউভুক্ত দেশ বেলজিয়াম বাংলাদেশের দশম বৃহত্তম বাজার। গত অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৭৩ কোটি ডলারের পণ্য। পোশাকের পাশাপাশি পাট ও পাটজাত পণ্যেরও উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি আছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১১ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদ ও বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে কৃষি-প্রক্রিয়াজাত পণ্য, ফার্মাসিউটিক্যালস, তথ্যপ্রযুক্তি ও হালকা প্রকৌশল পণ্যের বাজার তৈরি করা জরুরি। পাশাপাশি নতুন বাজার হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দিকে নজর দিতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে যেকোনো অর্থনৈতিক বা কূটনৈতিক সংকট দেশের রপ্তানি আয়ে বড় ধাক্কা দিতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ