
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ সময় পর দেশের ঘরের মাঠে জাতীয় ফুটবল দলের এমন রকম উত্তাপ আর উত্তেজনা দেখা গেছে আজ, মঙ্গলবার। একদিকে প্রচণ্ড গরমে জনজীবন হাঁসফাঁস, অন্যদিকে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামের চারপাশে জনসমুদ্র। কারণ—বাংলাদেশ আজ সন্ধ্যা ৭টায় এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে মুখোমুখি হচ্ছে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ সিঙ্গাপুরের। খেলা শুরু হতে তখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাকি, কিন্তু দুপুর গড়াতেই স্টেডিয়ামের আশেপাশে সৃষ্টি হয় এক অভূতপূর্ব উৎসবের আবহ। ফুটবলপ্রেমীরা দলে দলে হাজির হয়েছেন খেলা দেখতে, যা দেশের সাম্প্রতিক ফুটবল ইতিহাসে বিরল।
ফুটবলে ফিরে আসছে সেই হারানো উন্মাদনা
ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে, তখন দেশের ফুটবল অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। দর্শকশূন্য গ্যালারি, মিডিয়ায় ন্যূনতম প্রচার আর সমর্থকদের আগ্রহের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশের ফুটবল ঐতিহ্য। কিন্তু আজকের এই দৃশ্য যেন ফুটবলের পুনরুত্থান ঘটার ইঙ্গিত। পল্টন মোড় থেকে শুরু করে গুলিস্তান, দৈনিক বাংলা মোড়, রাজউক ভবন, এমনকি বায়তুল মোকাররমের আশপাশ পর্যন্ত জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাজার হাজার ফুটবল অনুরাগী।
টিকিট পাওয়া যেন একপ্রকার লটারি জেতার মতোই ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনলাইনে কিংবা অফলাইনে, যেখানে-সেখানে মিলছে না টিকিট। যারা কোনওভাবে হাতে পেয়েছেন সোনার হরিণসম টিকিট, তারাও দুশ্চিন্তায়—এই বিশাল ভিড় ঠেলে আদৌ মাঠে প্রবেশ করা যাবে কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
প্রচণ্ড গরমেও দমে নেই উন্মাদনা, দুপুরে গেট খুললেও ভিড় জমে সকালেই
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) আগেই জানিয়ে দিয়েছিল—ম্যাচের দিন দুপুর ২টা থেকে গেট খোলা হবে টিকিটধারী দর্শকদের জন্য। গেট ৩-এর সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানোর নির্দেশনা ছিল, দৈনিক বাংলা মোড় থেকে রাজউক ভবন পর্যন্ত দুটো লেনও প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। দুপুর ২টার আগেই হাজার হাজার মানুষ এসে ভিড় করেছেন স্টেডিয়ামের চারপাশে।
তীব্র রোদ আর উচ্চ তাপমাত্রা উপেক্ষা করেই ভক্তরা অপেক্ষা করছেন প্রিয় জাতীয় দলকে মাঠে চাক্ষুষ দেখতে। শহরের এই অংশে যেন একপ্রকার মেলা বসে গেছে। পতাকা, ব্যাজ, জাতীয় দলের জার্সি, মুখে রঙ মেখে সজ্জিত সমর্থকেরা শুধু খেলা দেখতেই নয়, যেন এক উৎসব উদযাপন করতেই জড়ো হয়েছেন। হামজা চৌধুরী, সমিত সোমসহ সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত বিদেশি বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়দের মাঠে দেখার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাচ্ছেন না কেউই।
ভুটান ম্যাচের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাড়তি সতর্কতা
মাত্র কয়েক দিন আগেই, গত ৪ জুন ভুটানের বিপক্ষে হওয়া ম্যাচে অব্যবস্থাপনার নজির রেখেছিল আয়োজক কর্তৃপক্ষ। বহু টিকিটধারী দর্শক স্টেডিয়ামে ঢুকতে পারেননি। আবার অনেকে টিকিট ছাড়া ঢোকার চেষ্টা করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলেন। স্টেডিয়ামের গেটও ভাঙার ঘটনা ঘটে, যা সমালোচনার ঝড় তোলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে আজ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আনা হয়েছে বাড়তি কড়াকড়ি। গেট ৩ ছাড়াও অন্য প্রবেশপথগুলোতে র্যাব, পুলিশ এবং সাদা পোশাকধারী গোয়েন্দা সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, নিরাপত্তা জোরদারে বিশেষায়িত পুলিশ বাহিনী ‘সোয়াট’-কেও মোতায়েন করা হয়েছে। মাঠে ঢোকার শেষ সময় বিকেল ৫টা নির্ধারণ করা হয়েছে, এবং সবাইকে টিকিট দেখিয়ে নির্ধারিত গেট দিয়ে প্রবেশ করতে বলা হয়েছে।
টিকিটপ্রাপ্তির জন্য অপেক্ষা আর প্রবেশ নিশ্চিত করার সংগ্রাম
আজকের এই ম্যাচকে কেন্দ্র করে গ্যালারিতে উপস্থিত থাকতে চাওয়া দর্শকদের ভেতরেই যেন ছিল এক যুদ্ধ। একদিকে টিকিট সংগ্রহের যুদ্ধ, অন্যদিকে স্টেডিয়ামে প্রবেশ নিশ্চিত করার সংগ্রাম। কেউ কেউ পরিবার নিয়ে এসেছেন, কেউ এসেছেন প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে। অনেকে আবার দিনের কাজ ফেলে, ছুটি নিয়ে হাজির হয়েছেন গ্যালারিতে, শুধুমাত্র জাতীয় দলের প্রতি ভালোবাসা থেকে।
এই ম্যাচ ঘিরে যতটা না প্রতিযোগিতা রয়েছে মাঠে, তারচেয়ে বেশি প্রতিযোগিতা যেন গ্যালারিতে স্থান দখল করার ক্ষেত্রে। অনেকেই টিকিট না পেয়ে পল্টন মোড়, গুলিস্তান, বঙ্গভবন বা দৈনিক বাংলা মোড়ে দাঁড়িয়ে ম্যাচের উচ্ছ্বাস ভাগ করে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। বাণিজ্যিকভাবে কিছু এলইডি স্ক্রিন বসানোর দাবি থাকলেও সেটি আজ বাস্তবায়ন হয়নি।
ফুটবলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী সমর্থকেরা
মাঠের ফলাফল যাই হোক, আজকের এই দৃশ্য দেশের ফুটবলের জন্য আশার আলো হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন পর জাতীয় দলের খেলা ঘিরে দেশের সাধারণ মানুষের এভাবে উত্তেজিত হওয়া, গ্যালারি উপচে পড়া দর্শক, টিকিটের চাহিদা—সবমিলিয়ে মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশের ফুটবলের স্বর্ণযুগের দিনগুলো।
যদি এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়, নিয়মিত আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন করা যায়, এবং দর্শকবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়, তাহলে আবারও ফুটবল জনপ্রিয়তায় ক্রিকেটকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে—এমনটাই আশা করছেন বিশ্লেষকরা।
এক দর্শক বলছিলেন, “আমি ২০০৩ সালের মালদ্বীপ ম্যাচ দেখেছিলাম। আজকের পরিবেশটা আমাকে সেই দিনের কথা মনে করিয়ে দিল। ফুটবল আবার বাঁচুক—এটাই চাওয়া।”
খেলা শুরু হবে সন্ধ্যা ৭টায়। তবে রাজধানীতে আজ থেকেই শুরু হয়ে গেছে ফুটবল উৎসব। মাঠে ১১ জন খেলবেন, কিন্তু গ্যালারিতে গর্জন করবেন লাখো হৃদয়ের ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ ধ্বনি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ