
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের জন্য কঠোর আচরণ বিধিমালা চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এই বিধিমালায় সবচেয়ে আলোচিত এবং সময়োপযোগী সংযোজন হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহারের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্বাচনি প্রচারে মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর, মানহানিকর, কুৎসামূলক কিংবা পক্ষপাতদুষ্ট কনটেন্ট তৈরি বা প্রচারের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) অনুষ্ঠিতব্য কমিশনের নিয়মিত সভায় এই আচরণ বিধিমালা অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হচ্ছে। ইসি সূত্র বলছে, খসড়া নীতিমালার প্রায় সবগুলো বিষয় দেশের রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।
কমিশনের প্রস্তাবিত আচরণবিধির উল্লেখযোগ্য নতুন সংযোজন হচ্ছে— কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence - AI) প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে কঠোর অবস্থান। নির্বাচনি প্রচারে এডিট করা ভিডিও বা অডিও, ডিপফেইক কনটেন্ট, মিথ্যা খবর, বানোয়াট তথ্য কিংবা কারও চেহারা বিকৃত করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালালে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কমিশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এসব ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে অনেকেই প্রচারযুদ্ধে নামছেন। এসব কনটেন্ট ভোটারদের প্রভাবিত করে বিভ্রান্ত করতে পারে। এজন্য এআই সংক্রান্ত আলাদা ও কড়া ধারা যোগ করা হয়েছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, “নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বিভ্রান্তি ছড়ানো ও তথ্য বিকৃতি বড় চ্যালেঞ্জ হবে। উন্নত দেশগুলোও এটা মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। তবে আমরা গণমাধ্যম ও নাগরিকদের সহযোগিতায় এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চেষ্টা করব।”
খসড়া আচরণবিধির ১৬ নম্বর ধারায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্বাচনি প্রচারের বিস্তারিত নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন:
-
প্রতিপক্ষ প্রার্থী বা কোনো সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে ঘৃণাত্মক বক্তব্য দেওয়া যাবে না।
-
ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে জনমত প্রভাবিত করার চেষ্টা নিষিদ্ধ।
-
মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে ভোটারদের বিভ্রান্ত করা যাবে না।
-
প্রার্থীদের ছবি বিকৃত করে কনটেন্ট তৈরি ও প্রচার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
এই ধারায় আরও বলা হয়েছে, প্রার্থী বা সমর্থকদের যে কেউ আচরণবিধি ভঙ্গ করলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার অপরাধ দমন আইনে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নির্বাচনি প্রচারণা বা ভোটগ্রহণের দিন ড্রোন, কোয়াডকপ্টার বা এ জাতীয় যন্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া প্রচারণার উদ্দেশ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কনসার্ট কিংবা পার্টির আয়োজন করাও নিষিদ্ধ।
ভোটগ্রহণের দিন কেবল অনুমোদিত ব্যক্তিরাই যানবাহন ব্যবহার করতে পারবেন। সেইসাথে মোটরসাইকেল চালনায়ও বিধি আরোপ করা হয়েছে।
নগদ অর্থের লেনদেনেও কঠোর বিধি জারি করা হয়েছে।
-
রাজনৈতিক দল সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা এবং প্রার্থী ১০ হাজার টাকার বেশি নগদ লেনদেন করতে পারবেন না।
-
এর বেশি অর্থ লেনদেন হলে তা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে।
এইবারের আচরণ বিধিমালায় প্রথমবারের মতো প্রার্থীর দলীয় পটভূমি এবং নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নিয়ে অঙ্গীকার যুক্ত করা হয়েছে।
তফসিল-১ এর ‘দলীয় অঙ্গীকারনামা’তে বলা হয়েছে:
“আমার দলের মনোনীত প্রার্থী কখনোই কোনো নিষিদ্ধ বা নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন রাজনৈতিক দল/সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না বা এখনো নেই।”
এছাড়া প্রার্থীদের কাছ থেকেও একই রকম অঙ্গীকারনামা নেওয়া হবে।
সিইসির কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল— আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কিনা? জবাবে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ রয়েছে।” তবে দলের সমর্থকরা ভোট দিতে পারবেন বলে জানান তিনি।
এই বক্তব্য ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ইসি সামাজিক মাধ্যমে প্রচার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নির্বাচনি পোস্টার, ব্যানার ও লিফলেটের রঙ, আকার এবং ব্যবহার নিয়েও বিধিনিষেধ দিয়েছে।
-
ব্যানার: সর্বোচ্চ ১০ ফুট বাই ৪ ফুট
-
ফেস্টুন: সর্বোচ্চ ১৮ ইঞ্চি বাই ২৪ ইঞ্চি
-
লিফলেট/হ্যান্ডবিল: এ-৪ কাগজের সমান
-
সবকিছু সাদা-কালো রঙে ছাপাতে হবে
হেলিকপ্টারে প্রচার: শর্তসাপেক্ষ অনুমোদন
এই খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে— দলীয় প্রধান ছাড়াও এবার দলের সাধারণ সম্পাদক হেলিকপ্টার ব্যবহার করে প্রচার চালাতে পারবেন। আগে এই অনুমতি কেবল দলীয় প্রধানদের জন্যই সীমাবদ্ধ ছিল।
আচরণবিধির ১৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, তফসিল ঘোষণার পর প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনি এলাকার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনোভাবেই প্রচার চালাতে পারবে না। এমনকি ওই এলাকার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদেও সদস্য হিসেবে থাকতে পারবে না।
প্রাথমিকভাবে এই বিধি ছিল দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য। বিএনপির সুপারিশে তা সংশোধন করে শুধু নির্বাচনি এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করতে নির্বাচন কমিশনের এই নতুন আচরণবিধি প্রযুক্তি, অর্থ, প্রচার মাধ্যম ও সাংগঠনিক কার্যক্রমের ওপর নজিরবিহীন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। বিশেষ করে এআই ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা ও ডিজিটাল প্রচারে কড়া বিধি আগামী নির্বাচনকে প্রযুক্তি যুগের উপযোগী হলেও সীমার মধ্যে রাখতে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ