
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ এক মাসেরও বেশি সময় পর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) আবারও শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর হতে যাচ্ছে। স্থবিরতা ও উত্তেজনার অবসান ঘটিয়ে আজ রবিবার (৫ অক্টোবর) থেকে শুরু হচ্ছে নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষা কার্যক্রম। গত ৩১ আগস্টের সহিংস ঘটনার পর থেকে বন্ধ থাকা দেশের অন্যতম প্রাচীন কৃষিভিত্তিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি অবশেষে খুলছে প্রশাসনের সিদ্ধান্তে।
গত ৩ অক্টোবর সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ আবাসিক হলে ফিরতে শুরু করেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ধীরে ধীরে আবারও প্রাণচাঞ্চল্য ফিরতে দেখা গেছে। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে খালি থাকা হলগুলোয় ফের আলো জ্বলেছে, ছাত্রছাত্রীদের ব্যস্ততা ফিরে এসেছে ক্যাম্পাসে।
বাকৃবি ক্যাম্পাসে অচলাবস্থার সূচনা হয় ৩১ আগস্টের ঘটনার মধ্য দিয়ে। সেদিন কম্বাইন্ড ডিগ্রির দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন যে, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি অনুষদের ডিগ্রিকে একত্র করে কম্বাইন্ড ডিগ্রি চালু করা হোক, যাতে আন্তর্জাতিক মানে তাদের ডিগ্রির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে।
কিন্তু সেদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত একাডেমিক কাউন্সিল সভায় শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণ না হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দুপুর দেড়টার দিকে শিক্ষা পরিষদ তিন ডিগ্রির প্রস্তাব করলে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা উপস্থিত শিক্ষকদের আটকে রেখে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠলে বিকেলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর বহিরাগতদের হামলা হয়। এতে শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক মিলিয়ে অন্তত ১৫ জন আহত হন।
এই সহিংসতা পুরো ক্যাম্পাসে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি অবস্থান এবং বহিরাগতদের উপস্থিতিতে পরিবেশ এতটাই অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেদিন রাতেই জরুরি সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করে।
সেই রাতেই অনলাইনে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ নষ্ট হওয়ায় প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করছে।”
একই সঙ্গে ১ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে রাতারাতি হল ছেড়ে যেতে হয় হাজারো শিক্ষার্থীকে। অনেকেই তাড়াহুড়োয় ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রেখে চলে যান। ফলে ৩৪ দিনের জন্য স্থবির হয়ে যায় পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের পরও আন্দোলন থেমে থাকেনি। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল, কম্বাইন্ড ডিগ্রি কার্যকর করতে হবে এবং ঘটনার ন্যায্য তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা একাধিকবার প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করলেও সমাধান আসেনি।
অবশেষে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে প্রশাসন উদ্যোগ নেয়। গত ২৩ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের আরেকটি অনলাইন জরুরি সভায় পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই সভায় আবাসিক হল খোলার নির্দেশনাও দেওয়া হয়।
বিকেল ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কৃষিবিদ ড. মো. হেলাল উদ্দীনের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, “বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার স্বাভাবিক পরিবেশ বিরাজ করছে। তাই আগামী ৫ অক্টোবর থেকে যথারীতি ক্লাস ও পরীক্ষা শুরু হবে।”
এই ঘোষণার পর থেকেই শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করেন। “আমাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরছি”—এই স্লোগানে তারা পোস্ট ও ছবি শেয়ার করতে থাকেন।
৩ অক্টোবর সকাল থেকে ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীরা তাদের আবাসিক হলে ফিরতে শুরু করেন। হলে প্রবেশের সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, প্রহরী ও পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতিতে নিরাপদে শিক্ষার্থীদের আবাসনে তোলা হয়।
একজন চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী বলেন, “দীর্ঘ সময় ধরে ক্লাস বন্ধ থাকায় পড়াশোনায় বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। তবে আমরা এখন চাই বিশ্ববিদ্যালয় যেন শান্তিপূর্ণভাবে চলে।”
অন্যদিকে শিক্ষক সমাজও শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে ফিরে আসায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। একাধিক শিক্ষক জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান গবেষণা প্রকল্পগুলোও বন্ধ হয়ে পড়েছিল। এখন পুনরায় তা চালু করা সম্ভব হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন হলে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা নেওয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মতিউর রহমান হাওলাদার বলেন, “আমরা চাই বাকৃবি হোক জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র, কোনো প্রকার সহিংসতার নয়। শিক্ষার্থীরা যেন তাদের পড়াশোনা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারে, সেই পরিবেশ তৈরি করা আমাদের প্রধান লক্ষ্য।”
তিনি আরও বলেন, “শিক্ষার্থীদের দাবি আমরা শুনেছি, এবং ভবিষ্যতে একাডেমিক সংস্কারে তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।”
ক্যাম্পাসে ফিরে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, তারা আন্দোলনের পুনরাবৃত্তি চান না। বরং প্রশাসন ও শিক্ষার্থী একসঙ্গে বসে সমস্যার সমাধান করবে—এটাই তাদের প্রত্যাশা।
একজন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বলেন, “আমরা চাই প্রশাসন আমাদের ডিগ্রির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করুক। কিন্তু সেই দাবিতে আমরা কখনো সহিংসতা চাই না।”
দীর্ঘ ৩৪ দিনের বন্ধের পর বাকৃবি ক্যাম্পাসে ফের বইছে প্রাণের স্রোত। প্রশাসন ও শিক্ষার্থী উভয়েরই আশা— এবার আর কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হবে না।
এক সময় উত্তপ্ত হয়ে ওঠা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আবারও শান্তিপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ ফিরছে। ক্লাস, গবেষণা, এবং ছাত্রজীবনের স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পক্ষ এখন একসঙ্গে কাজ করছে।
বহু প্রতীক্ষার পর আজ খুলছে বাকৃবি, শিক্ষার্থীদের মুখে তাই একটাই কথা— “ফিরে এসেছি আমাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ