
ছবি: সংগৃহীত
গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার মূল দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের। অথচ দেশের বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সেই দায়িত্ব পালনে মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের ১১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্তত ৫২টি গবেষণা কার্যক্রমে কোনো অর্থই ব্যয় করেনি। এর মধ্যে আবার ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি শূন্য বরাদ্দে গবেষণা খাতে সম্পূর্ণ অনাগ্রহ দেখিয়েছে।
২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সংখ্যা বর্তমানে চার হাজারের বেশি। অথচ ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি গবেষণার জন্য এক টাকাও ব্যয় করেনি। একই চিত্র ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত সিটি ইউনিভার্সিটির ক্ষেত্রেও, যেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার হলেও গবেষণায় বিনিয়োগ নেই। এ ছাড়া দ্য পিপল’স ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়—এই পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও গবেষণায় কোনো অর্থ বরাদ্দ রাখেনি।
অন্যদিকে কিছু শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় বরাদ্দ দিয়ে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছে। এর মধ্যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় একাই ৬৪ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করেছে। এছাড়া নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (AIUB), ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (IUB), ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (UIU), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (DIU), ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ULAB) ধারাবাহিকভাবে গবেষণায় গুরুত্ব দিয়ে আসছে।
ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী—
-
২০টি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় শূন্য বরাদ্দ দিয়েছে।
-
২৪টি বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করেছে।
-
৮টি বিশ্ববিদ্যালয় পাঁচ থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে।
-
বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এর বেশি ব্যয় দেখালেও তার অনেকটাই নামকাওয়াস্তে।
অর্থাৎ ৯৯টি সক্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি গবেষণায় কার্যত অনাগ্রহী।
ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন— “আগে গবেষণা খাতে ভয়াবহ দুরবস্থা ছিল। কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা এটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে যে, বার্ষিক বাজেটের কমপক্ষে ২ শতাংশ গবেষণায় ব্যয় করতে হবে। ২০২৪ সালে কিছুটা উন্নতি হবে, ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে আরও অগ্রগতি দেখা যাবে, আর ২০২৬ সালে আমরা যুগান্তকারী পরিবর্তন দেখতে পারব।”
২০২৩ সালে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ১১০। তবে সাতটির কার্যক্রম তখনো শুরু হয়নি, চারটির কার্যক্রম স্থগিত ছিল। অর্থাৎ কার্যক্রম চলমান ছিল ৯৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৪১৪ জন। এত বিপুল শিক্ষার্থী থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা খাতে ব্যয়ের অবস্থা হতাশাজনক।
শিক্ষাবিদরা বলছেন—
-
বিশ্ববিদ্যালয় কেবল পাঠদান ও সনদ দেওয়ার জায়গা নয়; বরং গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণ তার মূল দায়িত্ব।
-
প্রথাগত পাঠ্যক্রমের বাইরে গিয়ে নতুন উদ্ভাবন ও গবেষণা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত উদ্দেশ্য পূর্ণ হয় না।
-
অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মূলত ভর্তি বাণিজ্য ও সনদ বিতরণে ব্যস্ত, কিন্তু শিক্ষার্থীরা প্রকৃতপক্ষে কতটা শিখছে বা চাকরির বাজারে টিকে থাকতে পারছে কি না, তা নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই।
২০২৩ সালের প্রতিবেদনে ইউজিসি সরাসরি কোনো সুপারিশ করেনি। তবে কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ গবেষণা শুরু করে, তবে শিল্প খাত তাদের চাহিদা বিশ্ববিদ্যালয়কে জানাতে পারবে। গবেষকরা সেই সমস্যা সমাধানে কাজ করতে পারবেন, আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিল্পখাত থেকে অর্থায়নও পাবে। এতে গবেষণা সমৃদ্ধ হবে, পণ্যের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ঘটবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাষ্ট্রীয় বাজেটের ওপর কম নির্ভরশীল হবে।
২০২৩ সালে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় এক টাকাও ব্যয় করেনি তাদের মধ্যে রয়েছে—
-
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি
-
সিটি ইউনিভার্সিটি
-
দ্য পিপল’স ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
-
আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
-
সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
-
বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
-
ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
-
ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
-
জেড. এইচ. সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
-
নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
-
জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
-
রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া
-
সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি
-
ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ
-
আনোয়ার খান মডার্ন ইউনিভার্সিটি
-
জেড. এন. আর. এফ. ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেস
-
আহসানিয়া মিশন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
-
খুলনা খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়
-
ইউনিভার্সিটি অব ব্রাহ্মণবাড়িয়া
-
ইউনিভার্সিটি অব স্কিল এনরিচমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি
-
আরটিএম আল-কবির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি
-
চট্টগ্রাম বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি
প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খাত দিন দিন প্রসারিত হলেও গবেষণায় তাদের সাফল্য নেই বললেই চলে। মাত্র কয়েকটি শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকিরা গবেষণায় আগ্রহী নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি এ প্রবণতা না বদলায়, তবে দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কখনোই বৈশ্বিক মানের গবেষণায় জায়গা করে নিতে পারবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ