
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দেশের আয়কর ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ, সহজ ও করদাতা-বান্ধব করতে নতুন এক উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে করদাতাদের অনলাইন রিটার্ন (ই-রিটার্ন) দাখিলের সময় ব্যাংকের কিছু নির্দিষ্ট তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে কর ব্যবস্থায় যুক্ত হবে। ফলে করদাতাদের আলাদাভাবে ব্যাংকে গিয়ে সনদ সংগ্রহ করতে হবে না।
এনবিআরের সর্বশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী, করদাতার ব্যাংক হিসাবের চার ধরনের তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে ই-রিটার্নে যুক্ত হবে। এগুলো হলো—
১. সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের ৩০ জুন তারিখে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ব্যালান্স,
২. পুরো অর্থবছরে ব্যাংক থেকে অর্জিত সুদের আয়,
৩. ব্যাংক কত টাকা উৎসে কর (টিডিএস) কেটে রেখেছে,
৪. ব্যাংকের নেওয়া চার্জ বা ফি।
এনবিআরের কর্মকর্তাদের দাবি, এই পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে রিটার্ন দাখিল প্রক্রিয়া যেমন সহজ হবে, তেমনি কর ফাঁকিও অনেকাংশে কমে আসবে। বর্তমানে করদাতাদের প্রতিটি ব্যাংক থেকে আলাদা করে স্টেটমেন্ট ও সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ এবং ভোগান্তিকর। অথচ এসব তথ্য যদি সরাসরি ব্যাংকের কোর ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে ই-রিটার্ন ফর্মে যুক্ত হয়, তাহলে করদাতা শুধু যাচাই করে দাখিল করতে পারবেন।
তবে এই উদ্যোগের বড় বাধা হলো ব্যাংক কোম্পানি আইন। বর্তমানে এই আইনে গ্রাহকের ব্যাংক তথ্য গোপন রাখার কঠোর বিধান রয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকিং তথ্য সরবরাহ করতে হলে ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। এনবিআরের প্রস্তাব অনুযায়ী, এই আইন সামান্য সংশোধন করলেই রিটার্ন সংক্রান্ত তথ্য ব্যাংকের সিস্টেম থেকে রিয়েল-টাইমে সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।
এই উদ্দেশ্যে গত ১৪ আগস্ট এনবিআর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ বিভাগে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। এতে আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা করদাতার পুরো ব্যাংক হিসাব দেখতে চান না, বরং রিটার্নে যে তথ্য করদাতাকে দিতে হয়—শুধু সেই নির্দিষ্ট তথ্যগুলোই স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিতে চান।
মঙ্গলবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, “আমরা ই-রিটার্ন ব্যবস্থা চালু করেছি। এখন করদাতারা রিটার্ন দাখিলের সময় ব্যাংক থেকে আলাদা সার্টিফিকেট ও স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করতে হয়। আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে, ব্যাংকের কোর ব্যাংকিং সিস্টেমের সঙ্গে ইন্টিগ্রেশন করলে এই তথ্যগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসবে। আমরা কোনো করদাতার ব্যাংক একাউন্টে প্রবেশাধিকার চাই না। শুধু রিটার্নে যে চারটি তথ্য দিতে হয়—সেগুলো আমরা ব্যাংক থেকে অটো নিয়ে নেব।”
তিনি আরও বলেন, “আইনে সামান্য পরিবর্তন আনলেই এই সিস্টেম বাস্তবায়ন সম্ভব। এতে করদাতা ও রাজস্ব বিভাগ দু’পক্ষই উপকৃত হবে। রাজস্ব খাতে শৃঙ্খলা আসবে, আবার করদাতাদেরও আলাদা ঝামেলা পোহাতে হবে না।”
এনবিআরের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিজনেস বার্তাকে বলেন, “আমরা করদাতাদের সব তথ্য চাইছি না। আমরা শুধু সেই তথ্য চাইছি যা কর রিটার্নে আগে থেকেই দিতে হয়। এটি করদাতাদের জন্যও সুবিধাজনক হবে। কারণ বর্তমানে যেসব করদাতার একাধিক ব্যাংক হিসাব আছে, তাদের প্রত্যেক ব্যাংক থেকে আলাদা আলাদা সনদ সংগ্রহ করতে হয়। রিয়েল-টাইম সংযোগ চালু হলে সেই তথ্যগুলো সরাসরি ই-রিটার্নে চলে আসবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের চাওয়া কেবল তিন ধরনের মূল তথ্য—সুদের আয়, উৎসে কর্তন করা কর, এবং অর্থবছরের শেষ দিনে হিসাবের ব্যালান্স। এর বাইরে কোনো ব্যক্তিগত বা গোপন লেনদেনের তথ্য আমরা চাইছি না।”
বর্তমানে দেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টিআইএনধারী (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বরধারী) রয়েছেন। এর মধ্যে গত বছর রিটার্ন জমা দিয়েছেন প্রায় ৪৫ লাখ করদাতা। তবে মাত্র ১৫ লাখ করদাতা অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করেছেন। এ বছর থেকে ই-রিটার্ন দাখিল সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশে প্রায় ১৮ কোটি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। বহু মানুষের একাধিক হিসাব থাকলেও অন্তত ৪ কোটি ভিন্ন গ্রাহক হিসাবধারী আছেন। অথচ তাদের অনেকেই আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন না। এনবিআরের কর্মকর্তারা মনে করছেন, ব্যাংক তথ্য রিটার্নের সঙ্গে যুক্ত হলে ফাঁকির সুযোগ কমে যাবে।
যদিও ব্যাংকাররা এই উদ্যোগে কিছুটা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, করদাতার ব্যাংক তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে এনবিআরের কাছে চলে গেলে গোপনীয়তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এতে অনেক গ্রাহক ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত হবেন। তবে এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, গোপনীয়তা নিয়ে ভয়ের কিছু নেই, কারণ কেবল রিটার্ন-সংশ্লিষ্ট তথ্যই নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, তিনি এখনও এনবিআরের কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি পাননি, তবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। তিনি বলেন, “বর্তমানে আমরা সবাই রিটার্নের সঙ্গে ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেই। এনবিআরের প্রস্তাব হলো, এগুলো সরাসরি ব্যাংকিং সিস্টেম থেকেই ই-রিটার্নে চলে আসবে। করদাতাদের সব তথ্য নয়—শুধু বাধ্যতামূলক তথ্যগুলোই নেওয়া হবে।”
এনবিআরের এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে করদাতাদের রিটার্ন দাখিল প্রক্রিয়া যেমন সহজ হবে, তেমনি আয়কর ফাঁকি রোধ ও রাজস্ব আদায় বাড়ানো সম্ভব হবে। তবে এজন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন অপরিহার্য। এখন দেখার বিষয়, সরকার কত দ্রুত আইন সংশোধন করে এই প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়িত করে।
বাংলাবার্তা/এসজে