
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে আবারও কনটেইনার জটের সংকট তৈরি হয়েছে। বহির্নোঙরে জাহাজের অবস্থানকাল কমাতে এবং দ্রুত বার্থিং সুবিধা দিতে গিয়ে বন্দরে একসঙ্গে ১৩টি জাহাজ ভেড়ার অনুমতি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এতে জাহাজের অবস্থানকাল উল্লেখযোগ্যভাবে কমে দুই দিনে নেমে এলেও বন্দরের ইয়ার্ডে কনটেইনারের চাপ বেড়ে গেছে বহুগুণে। ফলে কনটেইনারের জট নিরসনে কঠোর নির্দেশনা জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে ৪৮ হাজার ৭৫১ টিইইউএস (টোয়েন্টি ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিটস) কনটেইনার জমে আছে। ১৭ আগস্ট এই সংখ্যা আরও বেশি হয়ে ৪৯ হাজার ১৩১ টিইইউএসে পৌঁছেছিল, যা সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ রেকর্ড। যদিও বন্দরের মোট ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার ৫১৮ টিইইউএস, কিন্তু আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, লরি ও ক্রেন চলাচলের সুবিধার্থে অন্তত ৩০ শতাংশ জায়গা খালি রাখতে হয়। ফলে কার্যত ৩৭ থেকে ৩৮ হাজার কনটেইনার রাখাই বন্দরের জন্য স্বাভাবিক অবস্থা।
এই প্রেক্ষাপটে ধারণক্ষমতার সীমা অতিক্রম করে ইয়ার্ড ভরে উঠেছে কনটেইনারে। ফলে বন্দর কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, ধীর হয়ে যাচ্ছে ডেলিভারি প্রক্রিয়া। আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে, সময়মতো পণ্য ডেলিভারি না হলে শিল্প খাতের উৎপাদন বিঘ্নিত হবে।
এর আগে প্রধান জেটিতে সর্বোচ্চ ১০টি জাহাজ ভেড়ানো যেত। এতে একটি জাহাজের অবস্থানকাল ছিল গড়ে ৪–৫ দিন। কিন্তু এখন একসঙ্গে ১৩টি জাহাজ ভেড়ানোয় অবস্থানকাল কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ দিনে। এতে জাহাজ মালিকরা স্বস্তি পেলেও বন্দরে কনটেইনার নামার চাপ হঠাৎ বেড়ে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, “আমরা আমদানিকারক ও শিপিং এজেন্টদের চাপ কমানোর জন্য দ্রুত বার্থিংয়ের ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু এর ফলেই একসঙ্গে বিপুল সংখ্যক কনটেইনার বন্দরে নামছে, যা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।”
বন্দর কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি আমদানি কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ায় জাহাজ আগমনের হারও বেড়েছে। কিন্তু বার্থিং সীমিত থাকায় এতদিন বহির্নোঙরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো জাহাজগুলোকে। সমালোচনার মুখে এখন দ্রুত বার্থিং দেওয়া হচ্ছে, তবে এর ফলে নতুন সংকট দেখা দিয়েছে।
এই সংকট নিরসনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, জাহাজ থেকে যেদিন কনটেইনার নামবে, সেদিনই তা অফডকে নিয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ কনটেইনার আর বন্দরের ইয়ার্ডে পড়ে থাকতে পারবে না। আগে নিয়ম ছিল, আমদানিকারকরা প্রথম চারদিন পর্যন্ত বিনা শুল্কে কনটেইনার ইয়ার্ডে রাখতে পারতেন। ফলে তারা দেরিতে ডেলিভারি নিতেন, আর বন্দরে কনটেইনার জমে থাকত।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের জয়েন্ট কমিশনার মোহাম্মদ মারুফুর রহমান বলেন, “প্রথম ও দ্বিতীয় দিনের মধ্যেই কনটেইনার অবশ্যই অফডকে নিয়ে যেতে হবে। বিশেষ ক্ষেত্রে কাস্টমস কমিশনার ডুয়েল ডেলিভারির অনুমতি দিতে পারবেন, তবে তা ব্যতিক্রম হিসেবেই গণ্য হবে।”
বর্তমানে ২১টি বেসরকারি অফডকে কনটেইনার স্থানান্তরের সুযোগ আছে। কিন্তু বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, অফডকের সক্ষমতা ও যাতায়াত পথের যানজট বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। এমএসসি শিপিংয়ের হেড অব অপারেশন আজমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, “অফডকের সক্ষমতা, লজিস্টিক প্রস্তুতি, এবং রাস্তাঘাটের অবস্থা বিবেচনা না করলে সমস্যা আরও বাড়বে।”
এখন চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন ১২৫–১৩০টি জাহাজ আসে ৩০টিরও বেশি দেশি–বিদেশি শিপিং লাইনের মাধ্যমে। এদের মধ্যে গম, সিমেন্ট ক্লিংকার, কয়লা, স্ক্র্যাপ লোহা বহির্নোঙরে খালাস হয়। তবে কনটেইনার আমদানি-রপ্তানির জন্য বন্দরের জেটি ব্যবহার করতেই হয়। ফলে সংকট আরও জটিল হয়ে উঠছে।
বাংলাবার্তা/এসজে