
ছবি: সংগৃহীত
মুসলমানদের প্রথম কিবলা আল-আকসা মসজিদ—যা মুসলিম বিশ্বের কাছে যেমন ধর্মীয় আবেগের কেন্দ্রবিন্দু, তেমনি ফিলিস্তিনিদের কাছে স্বাধীনতা ও আত্মপরিচয়ের প্রতীক—সেটি এখন ধীরে ধীরে ইসরাইলি নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগেও যেটি অকল্পনীয় মনে হতো, আজ সেটি বাস্তব রূপ পাচ্ছে। এখন আল-আকসার ভেতরে ইহুদিরা প্রকাশ্যে প্রার্থনা করছে, গান গাইছে, পতাকা ওড়াচ্ছে, এমনকি সেজদাও দিচ্ছে।
উনিশ শতকের শেষদিকে অটোমান শাসনামলে জেরুজালেমের ধর্মীয় স্থানগুলোর জন্য করা ‘স্ট্যাটাস কো’ চুক্তি অনুযায়ী, আল-আকসা সম্পূর্ণ মুসলিম প্রশাসনের অধীনে থাকার কথা। ইসলামিক ওয়াকফ—যা জর্ডানের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত—ছিল এই প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। চুক্তি অনুযায়ী, মসজিদের ভেতরে শুধু মুসলিমরাই নামাজ পড়বে, আর অমুসলিমদের প্রবেশাধিকার নির্ধারণ করবে ওয়াকফ।
১৯৯৪ সালে ইসরাইল ও জর্ডানের মধ্যে হওয়া শান্তি চুক্তিতেও ওয়াকফ প্রশাসনের কর্তৃত্ব স্বীকৃত হয়। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে এই চুক্তি ভেঙে ইসরাইল ধীরে ধীরে আল-আকসার ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে শুরু করে।
২০০২ সালে এরিয়েল শ্যারনের নেতৃত্বে শতশত সশস্ত্র ইসরাইলি বাহিনীর আল-আকসায় প্রবেশ নতুন এক দুঃস্বপ্ন ডেকে আনে। এর পরপরই ফিলিস্তিনি বিদ্রোহ, যা দ্বিতীয় ইন্তিফাদা নামে পরিচিত, শুরু হয়। ইসরাইল তখন থেকেই নিয়মিত সেনা ও পুলিশ মোতায়েন করে মসজিদে প্রবেশ সীমিত করে এবং ওয়াকফের কর্তৃত্ব কেড়ে নিতে শুরু করে।
প্রথমে মসজিদের গেটগুলোতে সেনা মোতায়েন করা হয়। পরে তরুণ মুসল্লিদের প্রবেশে বাধা দেওয়া শুরু হয়। ধীরে ধীরে ইহুদিদের দলবদ্ধ প্রবেশকে নিয়মিত ও স্বাভাবিক করে তোলা হয়। এখন প্রতিদিন সকালে ও দুপুরে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে ইহুদিরা প্রবেশ করে প্রার্থনা করছে।
‘টেম্পল মাউন্ট অ্যাক্টিভিস্ট’ নামের চরমপন্থী সংগঠনগুলো এর নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদের দাবি—আল-আকসা ধ্বংস করে সেখানে ‘তৃতীয় মন্দির’ নির্মাণ করতে হবে। ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ শুধু তাদের সহায়তাই করছে না, বরং প্রকাশ্যে সমর্থনও দিচ্ছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর পরিস্থিতি আরও কঠোর হয়ে ওঠে। শুক্রবারের জুমায় ৬০ বছরের নিচে মুসল্লিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ফিলিস্তিনিদের অনেককে বাধ্য করা হয় রাস্তায় নামাজ পড়তে। এখন যেখানে আগে লক্ষাধিক মুসল্লি সমবেত হতো, সেখানে প্রতিদিন কয়েকশো মানুষ নামাজ আদায় করতে পারছেন।
২০২৪ সালে শুধু এক বছরেই ৫৬ হাজারের বেশি ইহুদি আল-আকসায় প্রবেশ করেছে। ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গভির নিজে আল-আকসায় প্রবেশ করে প্রকাশ্যে প্রার্থনা করেন। এভাবে ইসরাইল দেখাতে চাইছে যে, বাস্তবতা হলো—আল-আকসার সার্বভৌমত্ব এখন তাদের হাতেই।
চরমপন্থী ইসরাইলি রাজনীতিকরা এখন প্রকাশ্যে বলছেন, আল-আকসায় একটি সিনাগগ নির্মাণের পর ধীরে ধীরে পুরো মসজিদকে ধ্বংস করে সেখানে তৃতীয় মন্দির নির্মাণ করা হবে। হেবরনের ইব্রাহিমি মসজিদের মতো ধাপে ধাপে দখলের সেই একই কৌশল এখানে প্রয়োগ হচ্ছে।
ইসলামিক ওয়াকফের কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেছেন, এটি কোনো সাময়িক অনুপ্রবেশ নয়; বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি ইহুদিকরণ প্রকল্প। সময়মতো প্রতিরোধ গড়ে তোলা না গেলে একদিন মুসলিম বিশ্বকে বাস্তবতার কাছে নত হতে হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ