
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজস্ব খাতে দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন, আন্দোলন এবং প্রশাসনিক দ্বন্দ্বের পর অবশেষে পরিস্থিতি বড় ধরনের পরিবর্তনের দিকে এগোচ্ছে। দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে চলা আন্দোলন ও অবরোধের মুখে সরকার অধ্যাদেশ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে রাজস্বনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের নেতৃত্বে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব খাতের অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদেরই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসন ক্যাডারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের যে অভিযোগ উঠছিল, তা ভেঙে পড়তে যাচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি তৈরি করা সংশোধিত খসড়ায় অন্তত ১১টি ধারা পরিবর্তন ও সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সবকিছু চূড়ান্ত হলে খসড়াটি শিগগিরই উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হতে পারে।
গত ১২ মে অন্তর্বর্তী সরকার হঠাৎ করেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) বিলুপ্ত ঘোষণা করে। পরিবর্তে নতুনভাবে রাজস্বনীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ গঠন করে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এই দুই বিভাগকে ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব দেওয়া হয়—একটি নীতি প্রণয়ন করবে, আরেকটি কার্যকরভাবে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পালন করবে।
তবে ওই অধ্যাদেশ কার্যকর হওয়ার পরপরই কর ও কাস্টমস ক্যাডারের মধ্যে তীব্র আশঙ্কা দেখা দেয়। তাঁদের ধারণা ছিল, নতুন দুটি বিভাগের শীর্ষ পদগুলো দখল করে নেবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। এতে রাজস্ব সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের ভূমিকা উপেক্ষিত হবে।
এই আশঙ্কা থেকেই এনবিআরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কয়েক দফায় কঠোর আন্দোলন শুরু করেন। কর অফিস, কাস্টমস হাউজ ও অন্যান্য রাজস্ব দপ্তরে কর্মবিরতি, কর্মসূচি এবং “কমপ্লিট শাটডাউন” পালনের কারণে রাজস্ব খাত কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ফলে রাজস্ব আদায়ে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে, সাধারণ করদাতারা ভোগান্তিতে পড়েন এবং সরকারও সমালোচনার মুখে পড়ে।
সরকার আন্দোলন প্রত্যাহারের আহ্বান জানালেও নেতাকর্মীরা শুরুতে তা মানেননি। একপর্যায়ে সরকার কঠোর অবস্থান নেয়। বহু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়, বিভিন্ন দপ্তরে বদলি দেওয়া হয় এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কাস্টমস ও ট্যাক্স ক্যাডারের নয়জনসহ মোট ৩৬ জন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
শেষ পর্যন্ত আন্দোলন কার্যত ব্যর্থ হয় এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজে ফিরতে হয়। তবে সরকারের ভেতরে আলোচনা চলতে থাকে কিভাবে রাজস্ব খাতের নেতৃত্ব পুনর্গঠন করা যায়।
সংশোধিত খসড়ায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে সচিব নিয়োগের ধারা নিয়ে।
রাজস্বনীতি বিভাগের সচিব নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রস্তাব করা হয়েছে—“সামষ্টিক অর্থনীতি, বাণিজ্যনীতি, পরিকল্পনা, রাজস্বনীতি বা রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কাজে অভিজ্ঞ” কর্মকর্তাকেই নিয়োগ দিতে হবে।
রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব নিয়োগেও একইভাবে “রাজস্ব আহরণ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা” থাকা কর্মকর্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
অর্থাৎ, আর প্রশাসন ক্যাডার থেকে যেকোনো কর্মকর্তা এনে সচিব পদে বসানো যাবে না।
খসড়ায় আরও বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে—
রাজস্বনীতি বিভাগের আয়করনীতি, দ্বৈতকর পরিহার চুক্তি, আন্তর্জাতিক চুক্তি ও মতামত, শুল্কনীতি, ভ্যাটনীতি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কিত চুক্তি সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগের বিভিন্ন পদ রাজস্ব আহরণ কাজে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে পূরণ করতে হবে।
অন্যদিকে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের আয়কর, ভ্যাট, কাস্টমস আইন বাস্তবায়ন এবং মাঠ পর্যায়ের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত অনুবিভাগগুলোর পদও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের মধ্য থেকেই পূরণযোগ্য হবে।
আগের অধ্যাদেশে সুনির্দিষ্টভাবে বলা ছিল, এসব পদে বিসিএস (কর) ও বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে হবে। তবে নতুন প্রস্তাবে তা কিছুটা বিস্তৃত করা হলেও মূলত রাজস্ব খাতের অভিজ্ঞতাকেই কেন্দ্র করে পদ পূরণের কথা বলা হয়েছে।
প্রশাসনিক অনুবিভাগগুলোর ক্ষেত্রে খসড়ার ধারা ৭(৫)-এ বলা হয়েছে, এসব পদ রাজস্ব আহরণ ও জনপ্রশাসন সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে পূরণ করা হবে। আগের নিয়মে প্রশাসন ক্যাডার, কর ক্যাডার ও কাস্টমস ক্যাডার—এই তিন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত ছিল পদগুলো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, সংশোধিত খসড়ার সবচেয়ে বড় দিক হলো সচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের একক নিয়ন্ত্রণের অবসান। তাঁদের মতে, এই পরিবর্তন রাজস্ব ক্যাডার কর্মকর্তাদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ করবে।
একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা সবসময় দাবি করে এসেছি যে রাজস্ব খাতের নীতি নির্ধারণে ও আদায়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদেরই নেতৃত্বে থাকতে হবে। এখন যেহেতু সংশোধিত খসড়ায় সে বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, আমরা মনে করি এটি রাজস্ব খাতের জন্য ইতিবাচক।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত রাজস্ব প্রশাসনে একটি বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন আনবে। এখন পর্যন্ত দেশের সর্ববৃহৎ রাজস্ব আদায়ক সংস্থা মূলত প্রশাসন ক্যাডারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ফলে রাজস্ব ক্যাডারের কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি প্রণয়নে অবহেলিত হয়ে আসছিলেন।
নতুন সংশোধন কার্যকর হলে তাঁরা কেবল মাঠপর্যায়ে রাজস্ব আদায় নয়, বরং নীতি প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনাতেও নেতৃত্ব দিতে পারবেন। এতে রাজস্ব প্রশাসনের দক্ষতা ও জবাবদিহি দুটোই বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রাজস্ব খাত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে দ্বন্দ্ব চলছিল, সংশোধিত অধ্যাদেশ তার একটি সমাধান দিতে পারে। আন্দোলন-সংকট, বরখাস্ত-বদলি এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে কাঁপতে থাকা এনবিআরের কর্মকর্তারা এখন অপেক্ষা করছেন—সংশোধিত অধ্যাদেশ চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে তাঁদের দীর্ঘদিনের দাবি কতটা বাস্তবায়িত হয়।
বাংলাবার্তা/এসজে