
ছবি: সংগৃহীত
দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, নৃশংসতা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যকারিতা নিয়ে জনমনে যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, তা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে মূল্যায়ন করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি স্পষ্টভাবে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, কোনো আবেগতাড়িত বা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে যেন আবারো দেশে চরমপন্থা কিংবা ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। এজন্য রাজনৈতিক দল, আন্দোলনকারী সংগঠন এবং গণতন্ত্রকামী জনগণকে দায়িত্বশীল ও সতর্ক ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান তিনি।
শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ফার্মগেটের কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘গণঅভ্যুত্থান ২০২৪: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবদান ও শহীদদের স্মরণে স্মরণসভা’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন তিনি। এ আলোচনা সভাটি ছিল জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত। অনুষ্ঠানে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার এবং রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ গঠনে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা নিয়ে উঠে আসে নানা গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য।
তারেক রহমান বলেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জনের একমাত্র বৈধ মাধ্যম হওয়া উচিত জনগণের রায়, আস্থা ও বিশ্বাস। প্রশাসনিক কৌশল, রাষ্ট্রীয় শক্তি কিংবা রাজনৈতিক চাতুর্যের ওপর নির্ভর করে যদি কেউ ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে সেটি হবে গণতন্ত্রের সাথে প্রতারণা। তিনি বলেন, “যদি আমরা জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে আমাদের সব আয়োজনই ব্যর্থ হবে, টেকসই হবে না।”
তিনি আরও বলেন, জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে যে এই নির্বাচন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে এক চূড়ান্ত পরীক্ষা। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রতিষ্ঠিত একটি জবাবদিহিমূলক সরকার ছাড়া স্বাধীনতার লক্ষ্য পূরণ সম্ভব নয়।
তারেক রহমান আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “সম্প্রতি সংঘটিত কিছু নৃশংস ঘটনা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দক্ষতা ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জনমনে প্রশ্ন তৈরি করেছে। সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সাধারণ মানুষের বক্তব্যে যে উদ্বেগ প্রতিফলিত হচ্ছে, তা উপেক্ষা করা যাবে না।” তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের একটি অংশ কোনো পক্ষকে সুবিধা দিতে চায় কিনা, তা নিয়েও মানুষ ভাবছে। “এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি করা যাবে না, যার সুযোগে ফ্যাসিবাদ আবার পুনর্বাসিত হওয়ার রাস্তা খুঁজে পায়।”
সরকারকে উদ্দেশ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, “সময়ক্ষেপণের কোনো সুযোগ নেই। যদি আপনারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তাহলে এখনই সাহসী ও স্বচ্ছ পদক্ষেপ নিতে হবে।” তিনি নির্বাচনকালীন সরকারের ওপর আস্থা তৈরি করতে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান এবং বলেন, “গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় ন্যায়সঙ্গত উদ্যোগের পাশে থাকবে।”
তারেক রহমান দেশের তরুণ ও শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, “তোমরাই আগামীর বাংলাদেশ। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তোমাদের সাহসী অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।” তবে শুধু রাজনৈতিক স্লোগানে নয়, তরুণদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বদক্ষতায় নিজেদের গড়ে তোলার ওপরও গুরুত্ব দেন তিনি। তিনি বলেন, “বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে রাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষাকেই দিতে হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।”
তিনি আরও বলেন, “শহীদদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে হলে নিজেদের যোগ্য নেতা হিসেবে প্রস্তুত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোকে হতে হবে জ্ঞানের বাতিঘর।” পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক চেতনার পাশাপাশি লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করার আহ্বান জানান।
তারেক রহমান বলেন, “১৯৭১ সালের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা যেমন জাতির হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন, ঠিক তেমনি ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ শিক্ষার্থীরাও ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবেন।” তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, “এই সরকারের পতন এখন সময়ের ব্যাপার। ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে আমরা ‘এক দফা ফ্যাসিস্ট পতনের আন্দোলন’-এ রূপ দিয়েছিলাম। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আমরা আজ একটি মানবিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের দ্বারপ্রান্তে।”
তারেক রহমান উল্লেখ করেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন বিএনপির দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার অংশ ছিল। ২০১৪ সালেই তিনি লন্ডনের এক অনুষ্ঠানে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেন, “স্বাধীনতার এত বছর পরেও সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এটিকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনবে।” ২০১৮ সালে ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং এর ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ফসল বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আলোচনা সভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে অনুরোধ জানান, “নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে শহীদ পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিতে হবে।” তিনি একটি ‘শহীদ পরিবার কল্যাণ ফান্ড’ গঠনের প্রস্তাব দেন, যা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ছাত্র ও বিএনপি নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে পরিচালিত হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস সতর্ক করে বলেন, “আজ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চলছে। কোনো ষড়যন্ত্র সফল হতে দেওয়া যাবে না। জনগণই এর জবাব দেবে।”
সভাপতিত্ব করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তৌফিকুল ইসলাম মিথিল। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন—বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী, কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরী, ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব, গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের স্বজন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
সবশেষে তারেক রহমান বলেন, “শহীদদের আত্মদান বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে এমন একটি বাংলাদেশ গড়া, যেখানে ইনসাফ, গণতন্ত্র এবং মানবিক মূল্যবোধই হবে রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ