
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে যারা সেনাবাহিনীর সহায়তায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা বৃহস্পতিবার রাতে প্রকাশ করেছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। তালিকাটি সেই ৬২৬ জন ব্যক্তির পরিচয় ও পেশাগত পরিচিতি তুলে ধরে, যারা ৫ আগস্টের ঘটনাবহুল রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতার সময় প্রাণনাশের আশঙ্কায় দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
আইএসপিআর-এর পাঠানো বিবৃতিতে জানানো হয়, আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে ছিলেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে ছিলেন—
২৪ জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যারা তৎকালীন রাজনৈতিক সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন এবং নানা মহল থেকে হুমকির মুখে পড়েন;
৫ জন বিচারক, যাদের মধ্যে উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতিও ছিলেন বলে জানা গেছে, যিনি নিজ জেলা শহরে কর্মরত অবস্থায় গুরুতর নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েন;
১৯ জন বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তা, যাঁদের মধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাও অন্তর্ভুক্ত;
সবচেয়ে বড় অংশটি পুলিশ বাহিনীর সদস্য, সংখ্যা ৫১৫ জন। এদের মধ্যে ছিলেন এসপি, ওসি, এসআই ও কনস্টেবলসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা, যারা গণঅসন্তোষের সময় জনগণের রোষানলে পড়ার ঝুঁকিতে ছিলেন এবং বিভিন্ন থানায় হামলার পর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন;
এছাড়া বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন কর্মকর্তা ও শিক্ষাকর্মী, যাঁরা অধিকাংশই ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন;
এবং সর্বশেষে ৫১ জন পরিবারের সদস্য (স্ত্রী ও শিশু), যারা তাদের স্বজনদের সঙ্গে প্রাণরক্ষার প্রয়োজনে সেনানিবাসে প্রবেশ করেন।
বিবৃতিতে আরও জানানো হয়, আশ্রয়প্রার্থীদের তালিকা প্রস্তুত ও যাচাইয়ের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর সেনাবাহিনী তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছে, যাতে গুজব ও বিভ্রান্তি দূর হয় এবং বিষয়টি স্বচ্ছভাবে জাতির সামনে তুলে ধরা যায়।
এর আগে গত ১৮ আগস্ট আইএসপিআর একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে জানায়, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় একাধিক সরকারি কার্যালয়, থানা ও রাজনৈতিক কার্যালয়ে সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ওই সময়ে একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তি ও সরকারি কর্মকর্তার ওপর হামলার অভিযোগও উঠে আসে। এ প্রেক্ষিতে কিছু ব্যক্তি ও পরিবার নিরাপত্তার অভাবে সেনাবাহিনীর সরাসরি সহায়তা কামনা করেন এবং সেনানিবাসে আশ্রয় নেন।
আইএসপিআর জানায়, বিচারবহির্ভূত কোনো কর্মকাণ্ড এড়াতে, জীবনরক্ষা নিশ্চিত করতে এবং আইনের শাসন সমুন্নত রাখতেই সেনাবাহিনী তাদের সাময়িকভাবে আশ্রয় প্রদান করে।
পরে, পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় ৬১৫ জন নিজ উদ্যোগে সেনানিবাস ত্যাগ করেন। তবে অভিযোগ বা তদন্তাধীন মামলার ভিত্তিতে ৪ জনকে আইনানুগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়।
বর্তমানে মাত্র ৭ জন আশ্রয়প্রার্থী এখনও সেনানিবাসে অবস্থান করছেন, যাঁদের বিষয়ে এখনও নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি বা মামলা সংক্রান্ত বিষয় বিবেচনায় রাখা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই আশ্রয়প্রদান কর্মসূচি সামরিক বাহিনীর একটি মানবিক ও রক্ষণশীল ভূমিকা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সংবিধানসম্মত ও সময়োচিত ছিল। তবে এটি ভবিষ্যতের জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নিরাপত্তা অবকাঠামোর দূর্বলতাগুলোকেও নগ্নভাবে উন্মোচন করেছে।
আইএসপিআর প্রকাশিত তালিকার মাধ্যমে এই প্রথমবারের মতো স্পষ্ট হলো, সংকটকালে দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ও বেসামরিক সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা কতটা ঝুঁকিতে ছিলেন এবং নিরাপত্তার অভাবে কোথায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এ বিষয়ে সরকার এখন পর্যন্ত আলাদা করে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করেনি। তবে কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন আশ্রয়প্রাপ্ত ব্যক্তিদের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত ও ভবিষ্যতে এ ধরনের বিপর্যয় প্রতিরোধে একটি সমন্বিত নীতিমালার দাবি জানিয়েছে।
সম্পূর্ণ তালিকা দেখতে ক্লিক করুন
বাংলাবার্তা/এমএইচ