
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা যেন প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘতর করছে। অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে ইসরাইলি বাহিনীর টানা হামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় আরও অন্তত ৯৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া আহত হয়েছেন আরও আড়াই শতাধিক নিরীহ মানুষ, যাদের অনেকেই গুরুতর অবস্থায় চিকিৎসাধীন। এতে করে চলমান এই ভয়াবহ আগ্রাসনে গাজা উপত্যকায় নিহতের সংখ্যা পৌঁছেছে ৫৩ হাজার ৬৫৫ জনে, যা ২১ শতকের সবচেয়ে নিষ্ঠুর গণহত্যার অন্যতম নিদর্শন হয়ে উঠছে।
বৃহস্পতিবার (২২ মে) আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা এবং তুরস্কভিত্তিক আনাদোলু এজেন্সি এই মর্মান্তিক তথ্য তুলে ধরেছে। তারা জানায়, বুধবার ভোর থেকে টানা বিমান ও স্থল অভিযানের মাধ্যমে ইসরায়েল গাজা জুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ঘুমন্ত মানুষ, শিশু, বৃদ্ধ, নারী— কেউই রেহাই পায়নি এই বর্বর আগ্রাসনের হাত থেকে। মৃতদের অনেকেই শিশু এবং নারী বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
একই দিনে অধিকৃত পশ্চিম তীরের জেনিন শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে যাওয়া বিদেশি কূটনীতিকদের লক্ষ্য করেও ইসরায়েলি বাহিনী গুলি চালায়। এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র নিন্দা ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বারবার বেসামরিক নাগরিকদের এবং কূটনৈতিক মিশনকেও ইসরায়েল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে।
তুরস্কভিত্তিক সংবাদ সংস্থা আনাদোলু তাদের পৃথক প্রতিবেদনে জানায়, গাজা উপত্যকায় গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছেন ৮২ জন এবং আহত হয়েছেন আরও ২৬২ জন। তবে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নতুন হিসাব বলছে, এই সংখ্যা আরও বেশি—নিহত ৯৩ এবং আহত আড়াই শতাধিক। এ নিয়ে চলমান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আহতের মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২১ হাজার ৯৫০ জনে।
বিভিন্ন হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো আহতদের চাপে কার্যত ভেঙে পড়েছে। চিকিৎসা সরঞ্জামের তীব্র সংকট, বিদ্যুৎবিহীনতা ও নিরাপদ পানির অভাবে বহু চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। গাজার বহু হাসপাতাল আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং চিকিৎসকরা সীমিত সম্পদে প্রাণ বাঁচানোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও জানায়, বহু মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন। কেউ কেউ আহত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছেন, কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে পারছে না উদ্ধারকারী দল। ইসরায়েলি বাহিনী রাস্তাঘাট, অ্যাম্বুলেন্স এবং এমনকি মেডিকেল টিমের গতিবিধিও লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে। ফলে প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের সূচনা গত বছরের অক্টোবর মাসে হলেও, চলতি বছরের জানুয়ারিতে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু সেই চুক্তি কার্যকর থাকার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মার্চ মাসে ইসরায়েল সেই চুক্তি লঙ্ঘন করে পূর্ণমাত্রায় সামরিক অভিযান শুরু করে গাজায়। এরপর থেকে প্রতিদিনই বাড়ছে নিহত ও আহতের সংখ্যা।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ইসরায়েল তাদের স্থল অভিযানের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। বোমা হামলা আরও ঘন ঘন ও বিস্তৃত এলাকা জুড়ে চালানো হচ্ছে। গাজার উত্তরের পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনুস, রাফা, দেইর আল-বালাহ, মাজদাল এবং গাজা সিটির বিভিন্ন অংশেও ভারী গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলা চালানো হচ্ছে। অনেক এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনী জঞ্জাল পরিষ্কার করার অজুহাতে বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, যাতে ফিলিস্তিনিরা আর কখনো ফিরে এসে বসবাস করতে না পারেন।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বহুবার ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বললেও, কার্যকর কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। বরং জাতিসংঘের বেশ কিছু প্রস্তাব বারবার নিরাপত্তা পরিষদে বাধাগ্রস্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে। ফলে ফিলিস্তিনিরা মানবাধিকার রক্ষা সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা নিয়েই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে।
এই পরিস্থিতিতে গাজার মানুষ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। খাদ্য, পানি, ওষুধ, বিদ্যুৎ—সবকিছুরই তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা সীমিত পরিমাণে সীমান্ত দিয়ে ঢুকলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। ইসরায়েল এসব ত্রাণ সরবরাহেও বারবার বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজায় এখন যা চলছে, তা নিছক যুদ্ধ নয়—বরং এটি একটি পরিকল্পিত গণহত্যা। লক্ষ্য একটাই: একটি জনপদকে বসবাসের অযোগ্য করে তোলা এবং ফিলিস্তিনি জাতিকে নিঃশেষ করা।
গাজার এই নির্মম বাস্তবতায় বিশ্বের বিবেকবান মানুষ এবং রাষ্ট্রগুলো কবে জেগে উঠবে, সেই প্রশ্ন এখন সময়ের সবচেয়ে বড় মানবিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এসেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ