
ছবি: সংগৃহীত
ঈদ-উল-আযহা বা কুরবানির ঈদ মুসলিমদের জন্য এক মহান ধর্মীয় উৎসব, যার মূল প্রতিপাদ্য হলো ত্যাগ। এই পবিত্র দিনে সারা দেশের প্রতিটি পরিবারে ঈদের কুরবানির মাংস রান্না ও ভোজনে বিরাজ করে এক বিশেষ আনন্দঘন পরিবেশ। গরু, খাসি কিংবা উটের মাংসে তৈরি হয় নানাবিধ সুস্বাদু খাবার—কোবাব, কালাভুনা, রেজালা, কোরমা, ভুনা খিচুড়ি, পায়া কিংবা চচ্চড়ি—একেক ঘরে একেক রকম রান্না, আর সেসবেই ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের আনন্দ। তবে আনন্দে মেতে উঠলেও অতিরিক্ত খাওয়া, বিশেষ করে চর্বিযুক্ত লাল মাংস অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ, শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদরা একাধিক গবেষণার ভিত্তিতে বলে থাকেন, ঈদের মাংস খাওয়া যাবে—তবে সেটি হতে হবে পরিমিত ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে। নইলে কেবল পেটের গণ্ডগোল নয়, দেখা দিতে পারে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধি, গেঁটে বাত, স্থূলতা থেকে শুরু করে কিডনির সমস্যাও। এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো কুরবানির ঈদের সময় অতিরিক্ত মাংস খাওয়ার ফলে শরীরের কী কী ক্ষতি হতে পারে এবং কীভাবে উৎসব উপভোগ করতে পারেন স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে।
অতিরিক্ত মাংস খাওয়ার শারীরিক ক্ষতির বিভিন্ন দিক
১. হজমের জটিলতা দেখা দিতে পারে
ঈদের দিনে অতিরিক্ত মাংস খাওয়ার ফলে সবচেয়ে সাধারণ সমস্যা হচ্ছে হজমের গণ্ডগোল। বিশেষ করে গরু বা খাসির চর্বিযুক্ত মাংস হজম হতে অনেক সময় নেয়, কারণ এগুলোতে প্রচুর স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে। এর ফলে গ্যাস, পেট ব্যথা, পেটে অস্বস্তি, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য এমনকি ডায়রিয়ার মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে। যাদের পিত্তথলি বা পাকস্থলিতে আগে থেকেই সমস্যা রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এ ধরণের খাবার আরও বেশি বিপজ্জনক হতে পারে।
২. হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে বহুগুণ
গরু ও খাসির মাংসে উচ্চমাত্রার স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং কোলেস্টেরল থাকে। অতিরিক্ত গ্রহণ করলে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের (LDL) মাত্রা বেড়ে যায়, যা হার্ট অ্যাটাক, উচ্চ রক্তচাপ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। যাদের আগে থেকেই হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ বা রক্তে চর্বির মাত্রা বেশি রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে কুরবানির মাংস সীমিত পরিমাণে না খাওয়া বিপদের কারণ হতে পারে।
৩. ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধির ঝুঁকি
প্রোটিনজাত খাবার, বিশেষ করে লাল মাংস বেশি খেলে রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যায়। ইউরিক অ্যাসিড জমে গেঁটে বাত বা গাউট নামক ব্যথাজনক আর্থ্রাইটিস সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে হাঁটু, পায়ের আঙুল, গোড়ালির মতো জায়গায় তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। এছাড়া যাদের কিডনির সমস্যা রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে ইউরিক অ্যাসিড নিঃসরণে বাধা তৈরি হতে পারে, যা কিডনির ওপর সরাসরি চাপ সৃষ্টি করে।
৪. ওজন বৃদ্ধি ও স্থূলতা
ঈদের সময় মাংসের সঙ্গে থাকে বিরিয়ানি, পরোটা, পোলাও, খিচুড়ি, নানা ধরণের ডেজার্ট ও ঠান্ডা পানীয়। এইসব খাবারে ক্যালরির পরিমাণ অনেক বেশি। অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ করলে দ্রুত ওজন বাড়ে, যা দীর্ঘমেয়াদে স্থূলতা, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ এবং এমনকি কিছু ক্যানসারের ঝুঁকি পর্যন্ত বাড়াতে পারে।
৫. কিডনির ওপর অতিরিক্ত চাপ
প্রোটিন হজম করতে গিয়ে কিডনিকে বাড়তি কাজ করতে হয়। ঈদের সময় অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণের ফলে যাদের কিডনির কার্যকারিতা আগে থেকেই দুর্বল, তাদের সমস্যা আরও বেড়ে যেতে পারে। কিডনি ফেইলিউরের ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে। তাই যাদের কিডনির সমস্যা আছে বা যারা কিডনির ওষুধ সেবন করছেন, তারা অবশ্যই ঈদের সময়ে মাংস খাওয়ায় সংযম পালন করবেন।
কীভাবে ঈদের মাংস উপভোগ করবেন স্বাস্থ্যসম্মতভাবে?
ঈদ মানেই আনন্দ, কিন্তু এই আনন্দের জন্য যেন স্বাস্থ্য বিপন্ন না হয়, সেজন্য দরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ সচেতনতা। নিচে দেওয়া হলো বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ—
পরিমিত খাওয়ার অভ্যাস গড়ুন
ঈদের দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত থেমে থেমে মাংস খাওয়ার প্রবণতা অনেকের মধ্যে দেখা যায়। এটি শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। একবারে বেশি মাংস না খেয়ে, অল্প অল্প করে দিনে কয়েকবার খেতে পারেন। প্রতিটি বেলার খাবারে সবজি, সালাদ ও আঁশযুক্ত খাবার রাখার চেষ্টা করুন।
চর্বি ও চামড়া বাদ দিন
মাংস রান্নার আগে চর্বিযুক্ত অংশগুলো কেটে বাদ দিয়ে দিন। খাসি বা গরুর চামড়া দিয়ে রান্না করা খাবার স্বাদে যতই ভালো হোক না কেন, এতে ফ্যাট ও কোলেস্টেরলের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। হৃদরোগ ও কোলেস্টেরলের সমস্যায় এই খাবার বিপজ্জনক।
স্বাস্থ্যসম্মত রান্নার পদ্ধতি অনুসরণ করুন
গ্রিল, সেদ্ধ, বেক বা কম তেলে রান্না করা পদ স্বাস্থ্যকর। অতিরিক্ত তেল বা ঘি দিয়ে রান্না না করাই ভালো। ঘন ঝোল ও বারবার ভাজা খাবার এড়িয়ে চলুন।
আঁশযুক্ত খাবার ও সবজির গুরুত্ব দিন
মাংসের সঙ্গে প্রচুর সবজি যেমন কুমড়া, লাউ, করলা, শাক ও অন্যান্য আঁশযুক্ত উপাদান রাখলে হজমের সহায়তা করে। এটি কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে ও শরীরে ভারসাম্য বজায় রাখে।
পর্যাপ্ত পানি পান করুন
ঈদের দিনে অনেকেই পানি কম পান করেন। কিন্তু মাংস বেশি খাওয়ার কারণে শরীরে পানির প্রয়োজন বেড়ে যায়। দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন, যা হজম ও রেচনে সহায়তা করবে এবং কিডনিকে সজীব রাখবে।
হালকা হাঁটাচলা করুন
খাওয়ার পর অলস হয়ে বসে না থেকে ২০-৩০ মিনিট হেঁটে নিন। এটি হজমে সহায়ক এবং গ্যাস্ট্রিকের ঝুঁকি কমায়।
আদা, লেবু ও মসলার ব্যবহার
রান্নায় আদা, জিরা, ধনে, লেবু ও হালকা মসলা ব্যবহার করলে হজমশক্তি বাড়ে। খাওয়ার পরে এক গ্লাস লেবুপানি পান করা যেতে পারে, যা পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে।
লবণ ও মসলা পরিমিতভাবে ব্যবহার করুন
অতিরিক্ত লবণ ও ঝাল হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বাড়ায়। তাই রান্নায় পরিমিত লবণ ও মসলা ব্যবহার করুন।
ঈদের খুশি শুধু জিহ্বার তৃপ্তিতে নয়, বরং পরিবারের সঙ্গে সুস্থ থেকে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেওয়াতেই প্রকৃত অর্থে উৎসবের সার্থকতা। তাই ঈদের দিনে কেবল স্বাদের পেছনে না ছুটে, নিজের শরীর ও স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে পরিমিত ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন। একটু যত্নবান হলে ঈদের আনন্দ আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে। সুখ, তৃপ্তি ও সুস্থতা—এই হোক কোরবানির মাংসের প্রকৃত স্বাদ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ