
ছবি: সংগৃহীত
অভাব আর প্রতিকূলতা যখন জীবনসঙ্গী, তখন সন্তানের মুখের হাসিই হয়ে ওঠে একমাত্র প্রেরণা। ঠিক তেমনই এক মানবিক দৃশ্য উঠে এসেছে গাইবান্ধার রিকশাচালক রাজু মিয়ার জীবন থেকে। ছেলের চাহিদা পূরণে এক অসাধারণ ভালোবাসার নিদর্শন স্থাপন করেছেন তিনি। মাত্র একটি পুরাতন সাইকেল ছেলেকে উপহার দিতে গিয়ে তিনি ঢাকা থেকে গাইবান্ধার উদ্দেশ্যে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথ বাইসাইকেল চালিয়ে পাড়ি দিয়েছেন মাত্র ২১ ঘণ্টায়।
রাজু মিয়া দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর ধরে ঢাকার মহাখালী এলাকায় রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তার আয়ের বেশিরভাগ অংশই চলে যায় গ্রামের বাড়িতে পরিবারকে পাঠাতে। বড় আশা তার, একমাত্র ছেলে রেজওয়ান ইসলাম যেন ভালোভাবে লেখাপড়া করে জীবনে কিছু হতে পারে। রেজওয়ান স্কুলের পাঠ শেষ করে বর্তমানে কলেজে ভর্তি হতে যাচ্ছে। কিন্তু কলেজে যাতায়াতের জন্য তার একটি বাইসাইকেল প্রয়োজন। ছেলের এই চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে রাজু মিয়ার যে ত্যাগ, তা এখন সারা দেশের মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।
সাইকেল কেনা, কিন্তু পৌঁছানোই চ্যালেঞ্জ
রাজু মিয়া বলেন, “ছেলেটা বলেছিল, বাবা একটা সাইকেল দিলে কলেজে যাওয়া সহজ হতো। আমিও চেয়েছিলাম ঈদের উপহার হিসেবে একটা বাইসাইকেল দিই।”
এই উদ্দেশ্যেই তিনি মহাখালীর একটি দোকান থেকে মাত্র ১,৫০০ টাকায় একটি পুরোনো বাইসাইকেল কেনেন। কিন্তু বিপত্তি বাধে সাইকেলটি বাড়ি পৌঁছাতে গিয়ে।
সাধারণত এই দূরত্ব পাড়ি দিতে একটি ভ্যান বা মিনিট্রাকে ৩,০০০ টাকার মতো খরচ হয়। কিন্তু ঈদের সময়টায় নিজের রিকশা বন্ধ রেখে, সংসার খরচ ও ঈদের কেনাকাটার পর রাজু মিয়ার হাতে ছিল মাত্র আড়াই হাজার টাকা। তার ভাষায়, “ভাড়া দিয়ে সাইকেল পাঠালে ছেলে হয়তো পেত, কিন্তু আমার আর ঈদ থাকতো না।”
এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে রাজু মিয়া এক সাহসী সিদ্ধান্ত নেন—সাইকেলটি নিজেই চালিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবেন। খরচ বাঁচিয়ে সন্তানের চাওয়া পূরণ করতে তিনি পবিত্র ঈদের আগের দিন, বৃহস্পতিবার (৫ জুন) ভোরবেলা ফজরের নামাজ পড়ে রওনা হন ঢাকার মহাখালী থেকে। সঙ্গে ছিল একটি ব্যাগ, কিছু খাবার আর অগাধ ভালোবাসা।
২১ ঘণ্টার দুর্ধর্ষ যাত্রা
প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে রাজু মিয়ার লেগেছে টানা ২১ ঘণ্টা। রাত গভীর হতেই তিনি পৌঁছান বগুড়ার মহাসড়কে। ক্লান্ত, অবসন্ন এই মানুষটির চোখে তখনও ছিল সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর অনির্বচনীয় আনন্দ। কিন্তু ঠিক তখনই ঘটলো এক অভাবনীয় ঘটনা।
সেনাবাহিনীর মানবিক সহযোগিতা
রাতের অন্ধকারে মহাসড়কে একজন মানুষকে সাইকেল চালাতে দেখে সন্দেহ হয় বগুড়ার একটি সেনা চেকপোস্টের। তাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে রাজু মিয়া নিজের কষ্টের গল্প বলেন। ছেলের জন্য কীভাবে একটি পুরনো সাইকেল কিনেছেন, তা নিজের হাতে পৌঁছে দিতে ২১ ঘণ্টা সাইকেল চালিয়েছেন—সব শুনে সেনাসদস্যরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
তারপরই তারা রাজু মিয়াকে বিশ্রাম নিতে বলেন, কিছু শুকনো খাবার দেন এবং সাইকেলসহ একটি মিনিট্রাকে তুলে দেন যাতে তিনি সহজে ও নিরাপদে বাড়ি পৌঁছাতে পারেন। রাজু মিয়া বলেন, “ওনারা যদি না থাকতেন, হয়তো আমার আরও কষ্ট হতো। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ, তারা না থাকলে সাইকেলটা হয়তো বাড়ি পৌঁছতো না।”
বিপদের পথেও পিছু হটেননি
এই যাত্রায় শুধু সাইকেল চালিয়েই তিনি পথ পাড়ি দেননি, কিছু স্থানে তাকে আরও কষ্টকর বিকল্পও নিতে হয়েছে। যমুনা সেতুতে বাইসাইকেল নিয়ে ওঠা নিষেধ থাকায় তাকে ১০০ টাকায় একটি মিনিট্রাকে উঠতে হয়। এছাড়া পথে আরও তিনবার, প্রতি বার ৫০ টাকা করে ভ্যানে করে কিছুদূর যাতায়াত করেন।
তবুও তার চোখে ছিল সন্তুষ্টির ছাপ। বলেন, “আমি জানতাম পথ কঠিন হবে। কিন্তু সন্তানের জন্য আমি কষ্ট করতে ভয় পাই না। ও যেন ভালোভাবে লেখাপড়া করে মানুষ হতে পারে—এই চাই।”
অসাধারণ এক পিতৃভালোবাসা
রাজু মিয়ার এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ভালোবাসা আর আত্মত্যাগের সংজ্ঞা। সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া অগণিত নিষ্ঠুর ঘটনার ভিড়ে এ যেন এক চুপিসারে আলো ছড়ানো গল্প, যেখানে রিকশাচালক বাবা সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করতে নিজের সীমিত সামর্থ্যের সবটুকু ঢেলে দেন।
এই সাইকেল শুধু একটি বাহন নয়, এটি এক পিতার অপরিসীম ভালোবাসা, আত্মত্যাগ ও মানুষের প্রতি আশার প্রতীক। এমন একটি ঘটনা আমাদের সমাজে মূল্যবোধের কথা নতুন করে মনে করিয়ে দেয়—যেখানে সন্তান সন্তুষ্টি যেন বাবার কাছে ঈদের সবচেয়ে বড় উপহার।
বাংলাবার্তা/এমএইচ