
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবাসী আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্রোত হিসেবে রেমিট্যান্সের অবদান অতুলনীয়। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত নতুন বিল ‘ওয়ান, বিগ, বিউটিফুল অ্যাক্ট’-এ অন্তর্ভুক্ত এক ধারা বিশ্বজুড়ে অভিবাসী সমাজ এবং তাদের নির্ভরশীল দেশগুলোতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। বিলটিতে প্রবাসীদের নিজ নিজ দেশে প্রেরিত রেমিট্যান্সের ওপর ৩.৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এর ফলে রেমিট্যান্সনির্ভর অর্থনীতিগুলো ব্যাপক ধাক্কায় পড়বে, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো।
বৃহস্পতিবার (৫ জুন) আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মার্কিন সিনেটে বিবেচিত এই নতুন বিলের কর ধারাটি মূলত অননুমোদিত অভিবাসী কর্মী ও কর দেয় না এমন প্রবাসীদের লক্ষ্য করে প্রস্তাবিত। তবে এতে যেসব প্রবাসী বৈধভাবে কাজ করছেন এবং নিয়মিত কর দিচ্ছেন তাদের ওপরও প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের প্রধান রেমিট্যান্স অর্থনীতিবিদ ড. দিলীপ রথা সতর্ক করে বলেন, কর ধারাটি বাস্তবায়িত হলে হুন্ডি, হাওলা, ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং হাতে নগদ বহনসহ অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে অর্থ প্রেরণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে, যা বৈধ আর্থিক ব্যবস্থার জন্য মারাত্মক হুমকি।
বাংলাদেশ ও ভারতের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে রেমিট্যান্সের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকাংশে প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার বড় অংশ এসেছে মধ্যপ্রাচ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এই অর্থেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বজায় থাকে, যা আমদানি ব্যয় ও মুদ্রাস্ফীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে সহায়তা করে। তাই কর আরোপ হলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন।
ভারতও রেমিট্যান্সে বিশ্বের শীর্ষে রয়েছে। ২০২৩ সালে ভারতের প্রবাসীরা দেশে প্রায় ১১৯ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন, যা ভারতের মোট বাণিজ্য ঘাটতির অর্ধেক পূরণ করেছে এবং সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের থেকেও বেশি। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক (আরবিআই) আশা করছে, ২০২৯ সালের মধ্যে এই পরিমাণ ১৬০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রাপ্ত এই রেমিট্যান্স ভারতের কেরালা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ু রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা বলছেন, এই কর বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ ও ভারতের মতো দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি বাড়বে, যার ফলে স্থানীয় মুদ্রার মান পতন, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অবশ্যম্ভাবী হবে। এটি সরাসরি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়াবে এবং দেশীয় বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে।
দিল্লিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিটিআরআই-এর প্রধান অজয় শ্রীবাস্তব মন্তব্য করেন, “রেমিট্যান্সে কর আরোপের ফলে পরিবারের ভোগব্যয় ও সঞ্চয়ের পরিমাণ কমে যাবে। মানুষ খাদ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদার জন্যই সীমিত অর্থ ব্যয় করবে, যা দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ ও উৎপাদন খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
সোশ্যাল সেক্টরে প্রবাসী পরিবারগুলোর ওপর সামাজিক ও মানসিক চাপও বৃদ্ধি পেতে পারে। অভাব-অনটন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পরবর্তী প্রজন্মের সম্ভাবনা। এই বিষয়গুলোও বিবেচনায় রেখে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দৃষ্টিকোণ পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তীব্র হয়ে উঠেছে।
বিশ্বব্যাংক ও গ্লোবাল ডেভলপমেন্ট সেন্টারের গবেষণায় দেখা গেছে, শুধুমাত্র মেক্সিকো প্রতিবছর ২.৬ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স হারাতে পারে। এর পাশাপাশি চীন, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনসহ লাতিন আমেরিকার অনেক দেশও এই কর প্রস্তাবের কারণে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বর্তমানে বিলটি মার্কিন সিনেটের অনুমোদন এবং প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছে। যদিও তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি, তবু বিশ্বজুড়ে অভিবাসী সমাজ ও রেমিট্যান্সনির্ভর দেশগুলো ইতোমধ্যেই সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবাসী আয়ের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মহল ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো ট্রাম্পের কর প্রস্তাবের পুনর্বিবেচনার দাবি তুলেছে। তারা বলছে, এটি কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হবে না, বরং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্যও বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, প্রবাসী কর্মীদের করদাতা হিসেবে উৎসাহিত করতে হবে, যাতে বৈধ আর্থিক মাধ্যমের ব্যবহার বৃদ্ধি পায় এবং অনানুষ্ঠানিক অর্থ প্রেরণ বন্ধ করা যায়। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই বিষয়টি সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে।
ট্রাম্পের প্রস্তাবিত রেমিট্যান্স করের বিষয়টি বর্তমানে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অঙ্গনে উত্তপ্ত বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি প্রবাসী আয় ও রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। এই কর আরোপ হলে শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব পড়বে। তাই সময় এসেছে বিশ্ববাসীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সংকট মোকাবিলায় কার্যকর কূটনৈতিক ও নীতিনির্ধারণমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করার।
রেমিট্যান্সের এই প্রবাহ যেন অব্যাহত থাকে, আর প্রবাসীদের উপার্জিত অর্থ নিরাপদে তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছায়—এটাই হবে বিশ্বশান্তি ও উন্নয়নের এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ